রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাগপুরে আরএসএস সদর দপ্তরে যান। আরএসএস’র প্রতিষ্ঠাতা কেবি হেডগেওয়ারের স্মৃতিসৌধ এবং গোলওয়ালকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সেখানে। নরেন্দ্র মোদীই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি আরএসএস’র সদর দপ্তরে উপস্থিত হয়ে তাদের প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এর আগেও আরএসএস প্রচারক অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি একবারের জন্যও সেখানে যাননি। ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীও যাননি সেখানে একবারও। প্রশ্ন হলো, বাজপেয়ী যাননি, মোদীও ১০ বছর যাননি, কিন্তু হঠাৎ তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কেন গেলেন! এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেখানে গিয়ে তিনি কি বললেন। সেখানে এবং পরে সঙ্ঘ আয়োজিত আর একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘সঙ্ঘ ভারতের অমর সংস্কৃতি এবং আধুনিকীকরণের বটবৃক্ষ, এই বিশাল বটবৃক্ষটি সাধারণ নয়।’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘এই বটবৃক্ষের আদর্শ এবং নীতিগুলি জাতীয় চেতনাকে রক্ষা করে।’ ‘২০২৫ থেকে ২০৪৭ গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল কারণ আমাদের সামনে বড় লক্ষ্য রয়েছে। আমাদের একটি শক্তিশালী এবং উন্নত ভারতের আগামী ১,০০০ বছরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে হবে।’
যাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গেছিলেন, তাঁদের অন্যতম এমএস গোলওয়ালকারের বক্তব্য কি ভারতবর্ষের গঠন নিয়ে? “হিন্দুস্তানের বিদেশি জাতিগুলিকে হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির অর্থাৎ হিন্দু রাষ্ট্রের গৌরবগাথা ছাড়া অন্য কোনও ধারণা পোষণ করা চলবে না এবং হিন্দু জাতির সাথে মিশে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে হবে, অথবা এই দেশে থাকতে হলে হিন্দু জাতির সম্পূর্ণ অধীন হয়ে থাকতে হবে, কোনও দাবি করা চলবে না, কোনও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়, এমনকি নাগরিক অধিকারের মতো কোনও বিশেষ সুবিধা তো দূরের কথা।" – ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ (ভারত পাবলিকেশনস, নাগপুর, ১৯৩৯)। প্রধানমন্ত্রীর মতে, ‘সঙ্ঘ ভারতের অমর সংস্কৃতি এবং আধুনিকীকরণের বটবৃক্ষ’। এই আদর্শ নিয়েই চলছে তার সরকার। এই জন্যই দেশ জুড়ে দাঙ্গা, সে মণিপুরই হোক বা উত্তর প্রদেশ। আর দাঙ্গা চললে, তিনি নীরব থেকে তাকে বাড়তে দেন। দেশের ঐক্য সংহতি যদি দেশের সংবিধান শপথ নেওয়া প্রধানমন্ত্রীই স্বয়ং নষ্ট করেন, তার চাইতে বড় অন্যায়, অপরাধ আর কিছু হতে পারে? তাঁর আরও বক্তব্য, ‘গত ১০০ বছরে আরএসএস’র তপস্যা তার সংগঠন এবং সমর্পণ এর ফল দেখাচ্ছে, যখন দেশ ২০৪৭ সালে 'বিকশিত ভারত'-এর লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।’ গোলওয়ালকার তাঁর লেখা ‘বাঞ্চ অব থট্’ (বেঙ্গালুরু: সাহিত্য সিন্ধু প্রকাশনা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ১৩৮, প্রথম প্রকাশ ১৯৬৬) প্রবন্ধ সংকলনে ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করেনি। তাঁর কথায়, “আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ অর্থ বোঝায় যে, ভারতীয় জাতি গঠিত হয়েছে সেই সকল মানুষকে নিয়ে যারাই এই ভূমিতে বাস করে... হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টানদের 'দেশবাসী' হিসাবে গণ্য করে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত শক্তি গড়ে তোলার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল।” অর্থাৎ জন্মলগ্ন থেকেই তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে পাকিস্তানের মতোই ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র চেয়েছিল। কেন সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনতার লড়াইতে অংশ নিয়েছিল এবং এদের সবাইকে নিয়ে স্বাধীন ভারত গড়ার স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কেন দেখেছিলেন, সেজন্যই নাকি তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেনি। এই বিষবৃক্ষের তলায় বসেই মোদী আবার দেশ ভাগ করতে চাইছেন। সেই উদ্দেশ্যেই জাত, ধর্ম, ভাষা এসবের ভিত্তিতে মানুষ ভাগ করার লক্ষ্যেই ওর সরকার তৎপর। আরএসএস’র বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষবৃক্ষের আশ্রয়েই আছে তাঁর সরকার, এই বার্তাই দিতে গিয়েছিলেন কি? গোলওয়ালকার, সাভারকাররা যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন করেছিলেন, উনি সেই পরম্পরা মেনেই এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনে ব্যস্ত, এই আশ্বাসও নিশ্চয়ই দিয়ে এসেছেন। বিপদ এখানেই। ঐক্যবদ্ধ দেশবাসীকেই রক্ষা করতে হবে সংবিধানে রক্ষিত গণতন্ত্র, ধর্মপেক্ষতা।
Comments :0