বুধবার রাজধানীর বুকে সাম্প্রতিক সময়ের বৃহত্তম শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরের সমাবেশ ঠাঁই পেল না সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। অতীতের মতোই, তবে এবারে নৈঃশব্দ আরও গভীর। সমাবেশে এসেছিলেন দেশের অন্তত ২৬টি রাজ্যের মানুষ। দাবি তুলেছেন শ্রমজীবীর জীবন-জীবিকার প্রশ্ন নিয়ে। আওয়াজ তুলেছেন, মোদী সরকার পরিবর্তনের। সম্ভবত এই কারণেই এই সমাবেশকে ‘বিপজ্জনক’ মনে করেছে বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যম।
টাইমস অব ইন্ডিয়া এই সমাবেশ নিয়ে একটি লাইনও লেখেনি। লেখেনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। দ্য টেলিগ্রাফ তাদের মুদ্রিত সংস্করণে কোনও সংবাদ দেয়নি। একই হাল অন্যান্য বড় আকারের সংবাদমাধ্যমে। টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়নি ছবি। ব্যতিক্রম ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকা। তারা পত্রিকার ৯নম্বর পাতায় একটি ছোট আকারের ছবি সহ সংবাদ প্রকাশ করেছে।
লক্ষণীয়, বৃহস্পতিবার অনেক সংবাদমাধ্যমেই বিজেপি’র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বিজেপি’র শীর্ষ নেতাদের দিয়ে ‘কলাম’ বা বিশেষ নিবন্ধ লেখানো হয়েছে। যেমন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লিখেছেন ভূপেন্দ্র যাদব। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লিখেছেন দলের প্রচার বিভাগের প্রধান অনিল বালুনি। এই প্রবণতা অবশ্য নতুন নয়। আজাজ আসরফ সম্প্রতি এক সমীক্ষা করে দেখিয়েছেন, তিন বড় পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ২০১৪-র মে থেকে থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৬৪০টি ‘কলাম’ বেরিয়েছে আরএসএস-বিজেপি’র শীর্ষ নেতাদের। বিজেপি সমর্থক নিবন্ধকারদের নয়, একেবারে শীর্ষ নেতাদের। এর অর্থ প্রতি ৫ দিনে একটি করে বিজেপি নেতাদের কলাম প্রকাশিত হয় শুধু এই তিন বড় কাগজেই। লেখক তালিকায় রয়েছেন নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং, ভেঙ্কাইয়া নাইডু, রবিশঙ্কর প্রসাদ, ভুপেন্দ্র যাদব, রাম মাধব। এই তিন পত্রিকায় গত আট বছরে রাম মাধবের ১৩২টি ‘কলাম’ প্রকাশিত হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ১৭ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিশেষ নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। সর্বভারতীয় হিন্দি সংবাদপত্রেও একই দশা। উত্তর, পশ্চিম ভারতের আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমে এই সংখ্যা আরও বেশি। টেলিভিশনে বিতর্কের নামে রোজই উপস্থিত করানো হয় বিজেপি’র নেতা-মুখপাত্রদের।
মেহনতি মানুষের লড়াই তো বটেই, তাদের জীবনের কথাও স্থান পায় না বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের কৃষি ও কৃষক সম্পর্কিত খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যমে মোট সংবাদের ১ শতাংশেরও কম। শ্রমিকশ্রেণি সম্পর্কে কার্যত নিষেধাজ্ঞা। ভারতে প্রায় ২৩ কোটি শ্রমজীবী পরিযায়ী। মহামারীর সময়ে লকডাউনে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ির দিকে ফিরে আসার জন্য রাস্তায় নামায় সেই দৃশ্যের কিছু প্রতিফলন পড়েছিল সংবাদমাধ্যমে। মহামারীর প্রকোপের অবসান ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই পরিযায়ীরাও উধাও হয়ে গেছেন গণমাধ্যম থেকে। দেশের সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে খবর ছাপার বা দেখানোর সময় হয় তখনই যখন গোরক্ষা, হিজাব, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কোনও ঘটনা ঘটে। অন্যথায় তারাও অনুপস্থিত। দলিত-আদিবাসীদের জীবন এতটাই অনুপস্থিত যে তাদের ওপরে বেড়ে চলা আক্রমণের সংবাদও প্রকাশ হয় না।
বুধবারই সুপ্রিম কোর্ট এক তাৎপর্যপূর্ণ রায়ে বলেছে, দেশের গণতন্ত্রকে সজীব রাখতে স্বাধীন মিডিয়ার বড় ভূমিকা রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্ব হলো নাগরিকদের কাছে সত্য ও বাস্তব পরিস্থিতিকে তুলে ধরা। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হলে আসলে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করা হবে। তাতে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। বিচারপতিরা আরও বলেছেন, নানা মতের বদলে একটাই মত প্রতিষ্ঠা করা বা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একই মত এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রে একটাই মত প্রতিষ্ঠা করা হলে তা হবে আসলে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে একটা বড় বিপর্যয়। মিডিয়ায় সরকারের নীতি নিয়ে সমালোচনামূলক মত প্রকাশ করে সংবাদ পরিবেশন কখনও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী বা দেশবিরোধী হতে পারে না।
কিন্তু পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই অভিমত, ভারতীয় বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমের বড় অংশই হয় পরোক্ষ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অথবা ‘স্বনিয়ন্ত্রিত সেন্সরশিপ’-এর অধীন। শ্রমজীবীর সংগ্রামের কথা তারা প্রকাশ করবেই বা কেন?
দিল্লির এই সুবিশাল সমাবেশ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবারই সিআইটিইউ’র তরফে বলা হয়েছে, অতি দক্ষিণপন্থীদের সরকার দেশের সাধারণ মানুষের ওপরে যে ভয়াবহ আক্রমণ নামিয়ে আনছে তার প্রতিরোধে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য পালটা শক্তি হলো মূল উৎপাদনকারী শক্তি ও শ্রমিক-কৃষক- খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ ও আরও তীব্র সংগ্রাম।
Sangharsh Rally
‘বিপজ্জনক’ সমাবেশ, চোখে ঠুলি মিডিয়ার
×
Comments :0