editorial

রণক্ষেত্রে নয় যুদ্ধ হচ্ছে মিডিয়ায়

সম্পাদকীয় বিভাগ

পহেলগামের বৈসরন ভ্যালিতে ২৬ জন ‍‌নিরপরাধ মানুষকে যে চারজন জঙ্গি খুন করেছে ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও তাদের কোনও হদিশ দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। ঘটনার ঠিক পরেই চটজলদি জঙ্গিদের ছবি প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু সেই জঙ্গিরা সীমান্তে কড়া নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে পাকিস্তানে চলে গেছে নাকি ভারতেই গা-ঢাকা দিয়ে আছে কিছু বলতে পারছে না তদন্তকারীরা। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ পাক-ভারতের যুদ্ধের দামামা, যাদের ধরতে এবং চরম সাজা দিতে এতো তোড়জোড় সেটাই এখন কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে আড়ালে চলে গেছে। ২৬ জনের খুনি জঙ্গিদের যদি ধরা না যায় তাদের যদি নজিরবিহীন সাজা দেওয়া না যায়‌ তাহলে নিহতদের জন্য ন্যায় বিচার মিলবে কি করে? এই আসল কাজটা না করে যতই হম্বিতম্বি করা হোক না তাতে যথার্থ অর্থে দায়িত্ব পালন হয় না। পাকিস্তানে সেনা অভিযান চালিয়ে বদলা নেওয়া, জঙ্গিদের  ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া, পাকিস্তানের বুকে থরথরি কম্পন তুলে দেওয়া, যতোটা সহজ তার থেকে অনেক কঠিন কাজ দেশের সীমান্তে নিশ্চিদ্র প্রহরা রাখা, বিদেশি  জঙ্গিদের ঢুকতে না দেওয়া। আরও কঠিন জঙ্গিরা সীমান্ত পেরিয়ে দেশে  ঢোকার  পর তাদের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা, জঙ্গি হামলা ঠেকানো এবং জঙ্গি হামলার পর তাদের  খুঁজে বার করে সাজা দেওয়া। মোদী-শাহদের নেতৃত্বে পরিচালিত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাবাহিনী এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  কাজেই সবচেয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দি‍‌য়ে চলেছে। সীমান্ত  থেকে কয়েকশো মাইল ভেতরে পাকিস্তানের কোথায় জঙ্গি ঘাঁটি আছে দেশে বসেই চিহ্নিত করা যায় এবং দেশে বসেই ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে সেগুলি ধ্বংস করে দেওয়া যায় কিন্তু দেশে জঙ্গিরা কোথায় থাকছে, কখন হামলা করছে তার কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। হামলার পরও তাদের টিকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা নিঃসন্দেহে মহা ধন্দের বিষয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় কোথায় ফাঁক, কেনই বা ফাঁক জানা ও বোঝা দরকার।
এই আসল কাজ থেকে নজর সরে গিয়ে দেশময় ঘৃণা ও বিদ্বেষের বন্যা  বইয়ে দেওয়া হয়েছে। আসল জঙ্গিদের খোঁজ না  পেয়ে সমস্ত কাশ্মীরি জনগণকে   সন্ত্রাসবাদী বলে  টার্গেট করা হয়েছে। এমনকি সমস্ত ভারতীয়  মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদী ও পাকপন্থী বলে দাগিয়ে দিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। কৌশলে দেশময় এক ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে।  সবটার পেছনে কাজ করেছে সূক্ষ্ম কৌশলী রাজনৈতিক  চাল। আর সেই গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে অনেকে।
কাশ্মীরে দীর্ঘস্থায়ী জঙ্গি কার্যকলাপে পাকিস্তানের মদত আছে সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে, বিশেষ  করে কাশ্মীরে জঙ্গি তৎপরতা চালানো হচ্ছে। তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে এটাই স্বাভাবিক। জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে পরিমিত আঘাত হয়েছে সেই পথেই। পাকিস্তান যদি বিনা  প্ররোচনায় আঘাত করে ভারত তার প্রত্যাঘাত দেবেই এবং দিয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। সমগ্র পাকিস্তান ধ্বংস করে দিতে অথবা ভারতের দখলে নিয়ে আসাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাস্তবে তার কিছুই ঘটেনি। যা ঘটেছে প্রতিরক্ষা বাহিনী সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দিচ্ছে। বাকি যে উন্মাদনা সেটা মূলত তৈরি করছে মিডিয়া। টিআরপি’র ‍ লোভে এবং নির্বুদ্ধিতার কারণে তারা তিলকে তাল বানিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এটা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতকে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ফুটবল ম্যাচের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে সত্যি সত্যি যুদ্ধ হলে কেউ জিতবে না। মরবে, ধ্বংস হবে, সর্বস্ব হারাবে দু’দেশের সাধারণ মানুষ।

Comments :0

Login to leave a comment