‘একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর’!
কয়লা, গোরু পাচারকাণ্ডে তদন্তের একের পর এক জেরা, গ্রেপ্তারিতে রীতিমতো বিধ্বস্ত শাসক শিবির। এরই মধ্যে এবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট লটারি কেলেঙ্কারির তদন্তে সক্রিয় হয়ে ওঠায় আরও বিপাকে শাসক তৃণমূল। ইতিমধ্যে সিবিআই গত তিনদিনে অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর মেয়ের মোট পাঁচবার লটারি জেতার রহস্য সামনে এনেছে। গত তিন বছরে শুধু অনুব্রত মণ্ডলের পরিবারেই লটারির পুরস্কার হিসাবে ২কোটি ১১লক্ষ টাকা ঢুকেছিল! আরও তাৎপর্যের হলো লকডাউনের সময়তেই একের পর এক লটারির ‘বিজেতা’ হয়ে গিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর কন্যা।
এরই মধ্যে এবার ইডি তাৎপর্যপূর্ণভাবে একটি লটারি সংস্থার কর্ণধার এবং এক ডিরেক্টরকে তলব করেছে। দিল্লিতে সদর দপ্তরে তলব করা হয়েছে ওই লটারি সংস্থার দুই শীর্ষ আধিকারিককে। আগামী সপ্তাহেই দিল্লিতে তাঁদের হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরাজ্যের এই গত কয়েক বছরে এই লটারি সংস্থারই রমরমা। গোটা দেশেই তাঁদের কারবার আছে।
ইডি’র একটি সূত্রে সামনে এসেছে আরও বিস্ফোরক তথ্য। জানা গিয়েছে যে, লটারি সংস্থার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে ইডি, যে সংস্থার কর্ণধারকে তলব করা হয়েছে দিল্লিতে। সেই লটারি সংস্থাই মমতা ব্যানার্জির দলকে নির্বাচনী বন্ডে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল!
জানা গিয়েছে, ২০২১’র ভোটেই এই টাকা দিয়েছিল ওই লটারি সংস্থা। তৃণমূলকে নির্বাচনী বন্ডে ১৫০কোটি অনুদান দেওয়া ঐ লটারি সংস্থারই একের পর এক বাম্পার পুরস্কার গত কয়েক বছরে জিতেছেন তৃণমূলের দাপুটে নেতা, নেত্রী কিংবা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত কয়েক বছরে এমনকি কোভিড পর্বে, লকডাউনের সময়ে রমরিময়ে কারবার চালায় ওই লটারি সংস্থা। শাসক দল ও প্রশাসনের মদত ছিল ওই সংস্থার পিছনে। ‘বিজেতা’ তৃণমূল নেতাদের ছবি দিয়েই লটারি সংস্থা প্রচার করেছিল, বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। শাসক তৃণমূলের এক ক্ষমতাবান সাংসদের সঙ্গেও ওই লটারি সংস্থার যোগের তথ্য রয়েছে। ওই সাংসদ ইতিমধ্যেই দুই কেন্দ্রীয় সংস্থারই মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে নজরে রয়েছেন, জেরার মুখেও পড়েছেন। তৃণমূল ঘনিষ্ঠতাই পশ্চিমবঙ্গে ওই লটারি সংস্থার রমরমার অন্যতম কারণ। তাই গোপনে নির্বাচনী বন্ডে ১৫০ কোটি টাকা বেমালুম অনুদানও পেয়ে যায় শাসক তৃণমূল।
ইডি’র একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, গোরু পাচারের তদন্তেই সামনে এসেছে লটারি কেলেঙ্কারির চেহারা। কোটি কোটি কাঁচা টাকা বেমালুম সাদা করার প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে ওই লটারি সংস্থাকে। ওই সংস্থার মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি মানি লন্ডারিংয়ের এক চক্র হিসাবে কাজ করেছে ঐ লটারি সংস্থা।
জানা গিয়েছে, এই প্রথম নয়, সাত বছর আগেও এই লটারি সংস্থাতে আয়কর দপ্তর তল্লাশি অভিযান চালায়। চেন্নাইয়ের সংস্থার কলকাতার একাধিক ঠিকানা, এজেন্ট ও আধিকারিকদের বাড়িতে ম্যারাথন তল্লাশি চালিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আয়কর দপ্তর প্রায় ৭০ কোটি টাকা নগদ বাজেয়াপ্ত করেছিল। হাওলার মাধ্যমে সৌদি আরব, ব্যাঙ্কক, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে টাকা পাচার করা হচ্ছিল। আয়কর দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছিল চেন্নাইয়ের বাসিন্দা এম নাগারাজন এই সংস্থার অন্যতম কর্ণধার। দক্ষিণ কলকাতাতেই ছিলেন দীর্ঘদিন। ‘কিং অব লটারি’ নামে পরিচিত স্যান্টিয়াগো মার্টিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবেই পরিচিত।
এই নাগারাজন ২০১২ সালেও চেন্নাই থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিল এই লটারি কেলেঙ্কারিতেই। ২০১৫ সালে কলকাতায় আয়কর দপ্তরের তল্লাশি ও ৭০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরে কারবারের গতি শ্লথ হয়েছিল। তা আবার বাড়ে ২০১৬’র বিধানসভা ভোটে তৃণমূল দ্বিতীয়বার সরকারের আসার পর থেকে। শাসক তৃণমূলের সঙ্গে এই লটারি সংস্থার ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে। চেন্নাই থেকেই মূলত চলে এই সংস্থার কারবার। সেখান থেকেই টিকিট ছাপা হয়। তারপর তা পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, আসাম সহ একাধিক রাজ্যে পৌঁছায়।
তৃণমূলকে বিপুল পরিমাণ টাকা গোপনে নির্বাচনী বন্ডে অনুদান দেওয়া সেই সংস্থার কর্ণধারকেই এবার তলব ইডি’র।
এদিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই সূত্রে এদিন জানা গিয়েছে অনুব্রত কন্যা সুকন্যা মণ্ডলের অ্যাকাউন্টে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে লটারির বিজেতার পুরস্কার হিসাবে আরও ৫০ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। সিবিআই আধিকারিকরা তদন্তে নেমে দেখেন শুধুমাত্র অনুব্রত মণ্ডল চলতি বছরের প্রথমে ডিয়ার লটারিতে ১কোটি টাকা জিতেছিলেন তা নয় তার আগেও মোট তিনবার তাঁর ও মেয়ে লটারিতে বাম্পার পুরস্কার জিতেছিলেন। ২০১৯ সালে অনুব্রত মণ্ডলের একটি অ্যাকাউন্টে লটারির পুরস্কার মূল্য হিসাবে ১০ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। তার আগে অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের অ্যাকাউন্টে দুদফায় লটারির টাকা ঢুকেছিল। প্রথমবার একটি অ্যাকাউন্টে ২৫ লক্ষ ও পরের বার ২৬ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। দু’দফায় মেয়ের অ্যাকাউন্টেই ঢুকেছিল লটারির ৫১লক্ষ টাকা! এরপর ২০২০ সালে ঢোকে আরও ৫০ লক্ষ টাকা আর অনুব্রত মণ্ডলের নিজে ‘জিতেছিল’ একবার ১কোটি আরেকবার ১০ লক্ষ। অর্থাৎ শুধু অনুব্রত মণ্ডলের পরিবারে ২কোটি ১১লক্ষ টাকা বেমালুম ঢুকে গিয়েছিল!
ইডি ও সিবিআই দুই সংস্থারই দাবি, গোরু পাচারের টাকা এভাবে ঘুরপথে অনুব্রত-সুকন্যার অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। কালো টাকা সাদা করার কৌশলেই তা করা হয়েছে। লটারি কেলেঙ্কারি আসলে এই কুৎসিত অর্থনীতির চেহারা। প্রকৃত বিজেতার কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে বাম্পার লটারির টিকিট কিনে নেওয়া হয়। নগদ টাকা দিয়ে ঐ টিকিট কিনে লটারি সংস্থার কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকা পেয়ে যান। ওদিকে কালো নগদ টাকা ততক্ষণে সাদা হয়ে গেছে বিজেতার কাছ থেকে টিকিট কিনে নেওয়ার পরে।
Comments :0