ভারত এবং জনগণের জীবনযাত্রার পক্ষে উদ্বেগজনক বিষয়গুলি নিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে অন্যান্য বামপন্থী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবে সিপিআই(এম)। সেই সঙ্গেই বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন ও পরাজিত করতে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তুলতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে পার্টি। রবিবার এক বিবৃতিতে এই অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি।
গত ২৭ থেকে ২৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় দপ্তর একেজি ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। সেই বৈঠকের আলোচনার নির্যাসকেই প্রকাশ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
কেন্দ্রীয় কমিটি এই বিবৃতিতে বলেছে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করার অপচেষ্টা, ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানোর লক্ষ্যে বিষাক্ত প্রচার, আদানি কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির অপব্যবহার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর আক্রমণের মতো জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মোকাবিলায় এবং জাতভিত্তিক জনগণনার দাবির পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তুলতেই হবে। দেশ ও জনগণের সামনে এই মুহূর্তে প্রধান কাজ হলো বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন করা ও পরাজিত করা।
সেই লক্ষ্যে সিপিআই(এম) ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে একসঙ্গে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপরে যে আক্রমণ নেমে এসেছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে এই ঐক্য গড়তে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে আগামী নির্বাচনগুলিতে বিজেপি-বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চ মাত্রায় একত্রিত করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তিকে যথাযথ কৌশল ঠিক করতে হবে। যেহেতু একেক রাজ্যে পরিস্থিতি একেকরকম, তাই এই বিরোধী ঐক্যের বোঝাপড়াকে অবশ্যই হতে হবে রাজ্যভিত্তিক।
কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে দেশের ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সেই প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আইএমএফ’র রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলির মধ্যে ভারতের জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) বাড়ছে সবথেকে দ্রুত গতিতে। এই তথ্যকে সামনে রেখে মোদী সরকার একপেশে প্রচারও চালাচ্ছে। কিন্তু আসল যে তথ্যকে আড়াল করা হচ্ছে, তা হলো, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৯.১ শতাংশ হলেও ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ওই হার ছিল মাইনাস ৫.৮ শতাংশ।
যে কোনও আর্থিক বছরের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার গণনা করা হয় আগের আর্থিক বছরের তুলনায় বৃদ্ধির সাপেক্ষে শতাংশের হিসাবে। স্পষ্টতই ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ধনাত্মক অঙ্কে জিডিপি বেড়েছে মাত্র ৪.১ শতাংশ। যদি ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ থেকে বিবেচনা করা হয়, যা ছিল প্রাক-করোনা স্বাভাবিক সময়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবর্ষ পর্যন্ত তিন বছরে ভারতের গড় বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার মাত্র ৩.৮ শতাংশ।
তথ্য আরও বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থনীতির আয়তন যেখানে ৩৫ হাজার কোটি ডলার বেড়েছে, সেখানে আমেরিকায় তা বেড়েছে ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ডলার এবং চীনে তা বেড়েছে ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। সমস্ত বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে ভারতের মাথাপিছু আয়ই সবথেকে কম। ভারতের তুলনায় মাথাপিছু আয় আমেরিকায় ৩১ গুন, চীনে ৫ গুন, ব্রাজিলে ৪ গুন, ব্রিটেনে ১৮ গুন এবং জার্মানিতে ২০ গুন।
শুধু তাই নয়। বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম জিডিপি’র দেশ হলেও ভারতের মাথাপিছু আয় আঙ্গোলা এবং আইভরি কোস্টের মতো দেশের তুলনায়ও কম।
দেশে শিল্প ক্ষেত্রের বিকাশ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে মোদী সরকারের ব্যর্থতাকেও বিবৃতিতে তুলে ধরা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, কারখানায় পণ্য উৎপাদন সহ শিল্প ক্ষেত্র মন্দা না হলেও বদ্ধদশার শিকার।
গত ফেব্রুয়ারিতে ৮টি মৌলিক পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ৭.২ শতাংশ, যা মার্চে অর্ধেক কমে হয়ে গিয়েছে ৩.৬ শতাংশ। পাশাপাশি দেশে বেকারত্বের হার অত্যন্ত চড়া, প্রায় ৮ শতাংশ। করোনার আগের পর্বে ২০২০’র জানুয়ারিতে দেশে কর্মসংস্থানের সংখ্যা ছিল ৪১ কোটি ১ লক্ষ, করোনার পরবর্তী সময়ে ২০২৩’র জানুয়ারিতে সেই সংখ্যা হয়েছে ৪০ কোটি ৯ লক্ষ। এর অর্থ, কর্মসংস্থানেও বদ্ধদশা চলছে।
গ্রামীণ মজুরিতেও গত আট বছর ধরে কার্যত একই চিত্র। রেগার প্রয়োজন যখন সবথেকে বেশি, তখন মোদী সরকার তার বাজেট বরাদ্দ এক-তৃতীয়াংশ ছাঁটাই করেছে। রেগার মজুরিও না দিয়ে দীর্ঘ সময় বকেয়া ফেলে রাখা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সিপিআই(এম) দাবি জানাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রকল্পগুলিতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে হবে, যা কর্মসংস্থানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে এবং অর্থনীতিতে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটাবে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারকে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কেলেঙ্কারির তদন্তে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করতে হবে এবং কুস্তিগীরদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে, একদিকে সরকার তার তদন্ত করতে চাইছে না এবং আরেকদিকে শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য ২ মে-র জায়গায় আরও ছ’মাস সময় চেয়েছে সুপ্রিম কোর্টের কাছে। সুতরাং সত্যকে সামনে আনতে হলে যৌথ সংসদীয় কমিটিই গঠন করতে হবে।
যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে দেশের পদকজয়ী কুস্তিগীরদের প্রতিবাদকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, প্রথম দিকে গা-ছাড়া মনোভাব দেখালেও দিল্লি পুলিশ ভারতের রেসলিং ফেডারেশনের সভাপতি ও বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে বাধ্য হয়েছে। এখনই ওই ব্যক্তিকে ফেডারেশনের সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং এফআইআর’র ভিত্তিতে দিল্লি পুলিশকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে বিজেপি সাংসদ কঠোর শাস্তি পান।
বিবৃতিতে জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ওখানে কোনও নির্বাচিত বিধানসভা নেই। বিধানসভা আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ প্রক্রিয়া, ভোটার তালিকার সংশোধন এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কাজ সম্পূর্ণ না হলে বিধানসভা নির্বাচন হবে না বলে এর আগে মোদী সরকার শর্ত দিয়েছিল। সরকারের নিজের দাবি অনুযায়ী, সব শর্তই পূরণ হয়ে গিয়েছে।
তারপরেও সেখানে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করার সিদ্ধান্তে বোঝাই যাচ্ছে, শাসক শক্তি ওখানে পছন্দের সরকার তৈরি করার বিষয়ে নিশ্চিত নয়। দ্রুত জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে, সেখানকার মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হবে মৌলিক সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। বিবৃতিতে জোরালো বিরোধিতা করা হয়েছে বন সংরক্ষণ আইনের সংশোধনীর।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, সংসদের সদ্য সমাপ্ত বাজেট অধিবেশনে বন সংরক্ষণ আইনের ধ্বংসাত্মক সংশোধনী পেশ করা হয়েছে। নিজস্ব এলাকায় কোনও প্রকল্পকে অনুমতি দেওয়া বা না দেওয়ার যে সাংবিধানিক ও আইনি ক্ষমতা রয়েছে গ্রামসভাগুলির, এই সংশোধনীর মাধ্যমে তা কেড়ে নিতে চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এই সংশোধনীতে বনাঞ্চলের জমির চরিত্র বদলের বিধি নমনীয় করা, বনাঞ্চলের বেসরকারিকরণে উৎসাহ দেওয়া এবং রাজ্যগুলির হাত থেকে বনাঞ্চল পরিচালনার প্রশাসনিক অধিকার কেন্দ্রকে হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে।
এই সংশোধনী আদিবাসী এবং বহু প্রজন্ম ধরে বনাঞ্চলে বসবাসকারীদের অধিকারের উপর আরও একপ্রস্থ আক্রমণ। এখন যে বনাঞ্চল অধিকার আইন আছে, এই সংশোধনীতে তাকেও সরাসরি লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাই এই সংশোধনী অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে সরকারকে।
ত্রিপুরায় বিজেপি’র ক্রমাগত আক্রমণের কড়া নিন্দাও করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। বিবৃতিতে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বিধানসভা নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরেও ত্রিপুরায় একটানা শারীরিক আক্রমণ এবং তোলা ও জরিমানা আদায় চালিয়ে যাচ্ছে শাসক বিজেপি। দাবি মতো টাকা না দিলে সম্পত্তি, দোকান, অটোরিকশার মতো জীবিকার উপকরণ প্রভৃতি ভেঙে তছনছ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। পরিণতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, অবিলম্বে এই হিংসা বন্ধ করতে হবে, সংবিধানের শাসন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং আক্রমণকারী দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
Comments :0