শহীদের গ্রামে পদযাত্রা ‘চোর তাড়াও’-র আহ্বান পৌঁছে দিচ্ছে। যেখানে ১২ বছর লাল ঝান্ডার মিছিল দেখেনি গ্রামবাসীরা, পদযাত্রা সেই তল্লাটের ভয় ভাঙছে। আবার কয়লা খনি, শিল্প এলাকায় অন্য রং। কৃষক, খেতমজুরের পাশে কয়লা খনি শ্রমিকরা ছিলেন। ফসলের দাম, একশো দিনের কাজের সঙ্গে জুড়েছে বন্ধ কারখানা খোলার দাবি।
প্রতিটি পদযাত্রায় আহ্বান— ‘তৃণমূল তাড়াও বিজেপি হটাও।’
রবিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের জুলপিয়া অঞ্চলে শহীদ কমরেড বিদ্যুৎ মণ্ডলের গ্রাম পীরখালিতে পদযাত্রা করেন বামপন্থী গণসংগঠনের কর্মীরা। পদযাত্রায় যোগ দিলেন শহীদের গ্রামের বাসিন্দারা। জুলপিয়ার প্রায় ১২ কিমি পথ পরিক্রমা করে এই পদযাত্রা। ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা প্রভাত চৌধুরি, শম্ভু কুর্মী, এরিয়া কমিটির সম্পাদক শ্যামল ডাল সহ স্থানীয় নেতৃত্ব। ২০১১ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর বিষ্ণুপুর ১ ব্লকের জুলপিয়া, পানাকুয়া, কুলেরদারি, আন্ধারমানিক সহ বিস্তীর্ণ এলাকা তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। গত ২৯ মার্চ সিপিআই(এম) কর্মী কমরেড বিদ্যুৎ মণ্ডলকে হত্যা করে সেই দুষ্কৃতীরা। প্রায় ১০ বছর পর এদিন সিপিআই(এম)’র আহ্বানে এদিন সন্ত্রস্ত জুলপিয়া অঞ্চলে পদযাত্রা হয়। বিষ্ণুপুর-১ ব্লকের জুলপিয়া অঞ্চল, পশ্চিম বিষ্ণুপুর অঞ্চল, বিষ্ণুপুর ২ ব্লকের চক এনায়েত নগর, বাখরাহাট অঞ্চলে পদযাত্রা পরিক্রমা করে।
এছাড়াও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড়ের বামনঘাটা, প্রাণগঞ্জ, সোনারপুরের খেয়াদহ-১, বারুইপুরের মদারাট অঞ্চল, সাউথ গড়িয়া, বজবজ-২ ব্লকের গজা পোয়ালি, ঠাকুরপুকুর মহেশতলা ব্লকের আশুতি-১, গোসাবা ব্লকের বালি-২, মথুরাপুরের ভেটকিপুর গ্রামে, মন্দিরবাজারের চাঁদপুর চৈতন্যপুরের বিভিন্ন বুথে পদযাত্রা হয়। সিপিআই(এম) সোনারপুর উত্তর এরিয়া কমিটির আহ্বানে রাজপুর সোনারপুর পৌরসভার ৮টি ওয়ার্ডে ট্যাবলো, প্লাকার্ডসহ সুসজ্জিত পদযাত্রা পরিক্রমা করে। সিপিআই(এম) নেতা কমল গাঙ্গুলি, অপূর্ব মণ্ডল সহ অন্যান্য নেতৃত্ব পদযাত্রায় ছিলেন।
সোচ্চার শহরাঞ্চলও। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির প্রতিবাদে সিপিআই(এম)’র উদ্যোগে যাদবপুরের ১০৩ ও ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডে মিছিল হয়। মিছিল হয় মহেশতলা পৌরসভার ২৬, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। বারুইপুর পৌরসভার ৮টি ওয়ার্ডেও পদযাত্রা হয়।
এদিন উত্তর ২৪ পরগণা জেলার মিনাখাঁ বাজার থেকে মালঞ্চ পর্যন্ত ১৫কিলোমিটার পদযাত্রা হয়। বহু মানুষ অংশ নেন।
পূর্ব বর্ধমানের বেরুগ্রাম এলাকায় পদযাত্রা আটকাতে তৃণমূল বোঁয়াইচণ্ডী গ্রামে মদ মাংসের বিপুল আয়োজন করে মানুষকে পদযাত্রার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এলাকার মানুষই তৃণমূলের হামলার ষড়যন্ত্র বানচাল করে দেয়। সুসজ্জিত বর্ণাঢ্য পদযাত্রা হয় বেরুগ্রামে। বেরুগ্রাম অঞ্চলে ১২বছর পর এমন লাল ঝান্ডার মিছিল হয়। তৃণমূলের হুমকি উপেক্ষা করে মানুষ মিছিলে শামিল হন। পথে পড়েছিল দৈয়ড়, আমড়াল। সেখানে জনসভা হয়। মিছিলে ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা মির্জা আক্তার আলি, সুপর্ণা ব্যানার্জি, বিনোদ ঘোষ, বিশ্বরূপ হাজরা, এবিপিটিএ’র নেত্রী চন্দনা পাল, অর্পণ ঘোষ, অভিজিত মণ্ডল প্রমুখ।
এদিন বর্ধমান সদর-২ এলাকার বৈকুন্ঠপুর ২ অঞ্চলের পদযাত্রা আলিসা গ্রাম থেকে শুরু হয়ে পেমড়া, নান্দুড়, চোতপুর, হাটশিমুলসহ বৈকুন্ঠপুর-২ অঞ্চলের ১০ টি গ্রাম এবং ১৪ টি বুথ অতিক্রম করে। সেখানেও বিপুল সাড়া মিলেছে। বানপোতা গ্রামে পদযাত্রীরা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন গ্রামের মানুষই। গলসী অঞ্চলে দরবারপুর গ্রাম থেকে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর –মহিলা, ছাত্র-যুব সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রার সূচনা করেন কৃষক নেতা সৈয়দ হোসেন। দরবারপুর থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রা গলসী বাজারের পুরানো নার্সিংহোমের সামনে শেষ হয়। বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ নেতা আভাস রায়চৌধুরি। গত ৩১ আগষ্টের আন্দোলনে গলসীর চারজন পার্টিকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁদের অভিনন্দন জানানো হয় গলসী গ্রামের দাস পাড়ার মোড়ে। গলসী অঞ্চল বাবলা শাখার মানুষরা পদযাত্রীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন। পদযাত্রায় ছিলেন আভাস রায়চৌধুরি, সৈয়দ হোসেন, সাইফুল হক, জাফর কাজী, মনিমালা দাস, কাজী জবুনেশা, মনসিজ হোসেন প্রমুখ।
এদিন সকালে পশ্চিম বর্ধমানের জেকেনগরের জেমেরি পঞ্চায়েতে কৃষক-খেতমজুরদের সঙ্গে কয়লাখনি শ্রমিকরা লাল ঝান্ডা নিয়ে হাজির হন সকাল থেকেই। ছাত্র-যুবরা হাজির লড়াইকে জোরদার করতে। পদযাত্রার মিছিল গ্রামে ঢুকতেই তৃণমূলের মাত্রাছাড়া দূর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। একশো দিনের কাজের মজুরির বকেয়া, শিক্ষকের চাকরি চুরি থেকে কয়লা,বালি চুরির বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে। একদিকে রুটিরুজি বিপন্ন, কৃষকের ফসলের দাম নেই। খেতমজুরদের কাজ নেই, মজুরি বাড়েনি। দুর্বিষহ অবস্থা। অন্যদিকে এই ক’ বছরেই তৃণমূলের পঞ্চায়েতের নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ। বাজনা, লাল ঝান্ডা, আর মানুষের জীবণযন্ত্রণার ছবি তুলে ধরেছে প্লাকার্ড, ব্যানারে। পানীয় জলের সমস্যার সমাধান নেই। পদযাত্রীদের মিছিল বন্ধ হয়ে যাওয়া অ্যালুমিনিয়াম কারখানার জেকেনগর বাজার, কয়লাখনির আবাসন, ওল্ড মাইনাস, বেলিয়াবাথান পৌঁছাতেই জনস্রোত আছড়ে পড়ে। মিছিলের শুরু থেকে শেষতক লাল ঝান্ডা নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গেই বিজেপি-কে হটানোর স্লোগান বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
পদযাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক রুনু দত্ত, সুপ্রিয় রায়, হেমন্ত প্রভাকর, পূর্ণদাস ব্যানার্জি, সাগর ব্যানার্জি, দিব্যেন্দু মুখার্জি প্রমুখ । বালকো কারখানা বন্ধ। স্টারলাইট কারখানা হস্তান্তর করে উৎপাদন তো করেইনি বরং মেশিনপত্র বিক্রির চেষ্টা করেছে। এলাকার মানুষ লাল ঝান্ডা নিয়ে রুখে দিয়েছে সেই প্রচেষ্টা। কয়লাখনি বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে চাইছে বিজেপি। খনিতে জোর লড়াই করছে শ্রমিকরা। জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে শিল্প-কারখানা বাঁচাতে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই দরকার।
Comments :0