Image Building

ভাবমূর্তির সঙ্কট

সম্পাদকীয় বিভাগ

২২ এপ্রিল পহেলগামে অভাবনীয় ও নজিরবিহীন সন্ত্রাসবাদী হামলায় ২৬জন নিরীহ মানুষের মৃত্যুর পর বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীরা পাল্লা দিয়ে নানা বিবৃতি-প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন একেবারে নীরব। টু শব্দটিও শোনা যায়নি তাঁর মুখ থেকে। তিনি তার পশ্চিম এশিয়া সফর কাটছাঁট করে জরুরিভিত্তিতে ফিরে এসেছেন বটে কিন্তু তাঁর সরকারেরই ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে যোগ দেননি। বদলে তিনি ভোটমুখী বিহারে চলে গেলেন প্রাক নির্বাচনী ভাষণ দিতে। বাজার গরম করা বক্তৃতা দিলেন সন্ত্রাসবাদী ও তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে। হামলাকারীদের মাটিতে মি‍‌শিয়ে দেবার হুঙ্কার ছাড়লেন। তাঁর হিন্দুত্ববাদী অন্ধ ভক্তদের প্রবলভাবে উত্তেজিত ও উন্মাদিত অন্ধ ভক্তরা টগবগ করে ফুটতে থাকে।
পহেলগামে হামলার ঘটনার পর হামলাকারীদের ধরার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতার মধ্যে যখন দেশময় জোরালো প্রশ্ন উঠতে শুরু করে তখন কপালের ভাঁজ বাড়তে থাকে মোদী-শাহ-রাজনাথদের। ৫৬ ইঞ্চির যাবতীয় হম্বিতম্বি ফাঁকা আওয়াজে পরিণত হতে থাকায় বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তি রক্ষায় কিছু একটা জরুরি হয়ে পড়ে। আগাম ঘোষণা ছাড়া প্রায় ১৫ দিনের মাথায় আচমকা শুরু করে দেওয়া হয় সামরিক অভিযান। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কথা মাথায় রেখে সামরিক অভিযানের নামকরণ করা হয় অপারেশন সিঁদুর। পালটা হামলা চালায় পাকিস্তানও। পরিস্থিতি ক্রমশ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে থাকলেও চারদিন পর আচমকাই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে দেন তাঁর মধ্যস্থতায় পাকিস্তান ও ভারত সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের কথা দু’দেশ মেনে নেওয়ায় তিনি দু’দেশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
শুধু ১০ মে যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা করেই ট্রাম্প ক্ষান্ত হননি। তারপর থেকে প্রতিদিনই কাশ্মীরকে ঘিরে পাক-ভারত সংঘর্ষ নিয়ে একের পর এক মন্তব্য করতে থাকেন। ইঙ্গিত দেন পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছিল তাতে যে কোনও সময় পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। সেটা আটকাতেই তিনি নাকি দু’দেশকে বাধ্য করেন যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হতে। এমনকি রাজি করানোর জন্য দু’দেশের বাণিজ্য বাড়াবার লোভ দেন। রাজি না হলে বাণিজ্য বন্ধ করার হুমকিও দেন। অর্থাৎ গোটা ঘটনায় ট্রাম্প নিজেকে আসল হিরো প্রমাণ করতে উঠে পড়ে নামেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ট্রাম্প প্রতিদিন নিজের মতো করে মন্তব্য করে মোদীর অস্বস্তি বাড়াতে থাকলেও ট্রাম্পের বক্তব্যের কোনও প্রতিবাদ, প্রতিক্রিয়া বা বিরোধিতা শোনা যাচ্ছিলো না মোদী সরকারের পক্ষ থেকে। যুদ্ধ বন্ধ করানোর পর ট্রাম্প কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে ভারত-পাককে সবরকম সাহায্য করা অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষ হিসাবে নাক গলানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তারপরও মোদীরা নীরব। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ভারতের নিজস্ব বিষয়ে এইভাবে অনর্গল কথা বলে যাবার পর তাকে সমর্থন বা অস্বীকার করে কোনও বিবৃতি না দেওয়ায় সন্দেহ দানা বাঁধে। তাহলে তো সত্যিসত্যি মোদীর ভারত ট্রাম্পের আমেরিকার কাছে মাথা নত করেছে। সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী ও সামরিক ঘাঁটিতে হামলা শুরু করেও বন্ধ করে দিতে হলো ট্রাম্পের চাপে। উল্টো দিকে পাকিস্তান ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানাচ্ছে আর ট্রাম্পও পাকিস্তানের ভূমিকায় খুশি। যুদ্ধ বন্ধের পর মোদী জাতির উদ্দে‍‌শ্যে ভাষণ দিলেও এবং বায়ুসেনা ঘাঁটিতে গিয়ে ভাষণ দিলেও ট্রাম্পের বক্তব্যের কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে প্রাণপণে চেষ্টা করে গেছেন ভক্তদের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব ধরে রাখতে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদীই যে আসল নায়ক তা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধোন্মাদনা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে দিয়ে পিছিয়ে আসায় ভক্তরা মনমরা হতাশ। মোদীর নেতৃত্বের দৃঢ়তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানকে শেষ না করে যুদ্ধ থামানো মোদীর চরম ব্যর্থতা ও দুর্বলতা। মোদীরা চেয়েছিলেন পহেলগাম এবং তাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ হবে তাদের পরবর্তী নির্বাচন জয়ের তুরুপের তাস। কিন্তু ট্রাম্প মাঝখানে ঢুকে পড়ে সব মাটি করে দিয়েছে। ৫৬ ইঞ্চির বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তিতে কালি লেপে দিয়েছে। এই অবস্থায় মোদীর ভাবমূর্তি রক্ষায় গোটা দলকে মোদীর জয় বলে রাস্তায় নামাতে হচ্ছে। মোদীকেও সোচ্চার হতে হচ্ছে উত্তেজক ভাষণের মধ্যে।

Comments :0

Login to leave a comment