রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এক বছর অতিক্রম করলেও যুদ্ধ বন্ধের কোনও লক্ষণ আপাতত দৃশ্যগোচর হচ্ছে না। যুদ্ধ বন্ধ করার কোনও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গোটা বিশ্বই যেন কেমন নিস্পৃহ ভূমিকা পালন করছে। বিপরীতে বিশ্বের তথাকথিত প্রভাবশালী দায়িত্বশীল দেশ যারা নিজেদের বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বঘোষিত ঠিকাদার বলে দাবি করে থাকে তাদেরই বরং দেখা যাচ্ছে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করার প্রয়াস চালাতে।
একটা আঞ্চলিক যুদ্ধকে তারা কৌশলে আন্তর্জাতিক চেহারা দেবার চেষ্টা করছে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী দুনিয়া যদি সত্যি সত্যি সমাধান চাইতো তাহলে যুদ্ধ শুরুর দু’মাসের মধ্যেই মীমাংসা সূত্র বার করা যেত। গত এপ্রিল মাসে যখন তুরস্কের উদ্যোগে আলোচনার ব্যবস্থা হচ্ছিল তখন ব্রিটেন ও আমেরিকা যদি ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার উসকানি না দিত এবং রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও অস্ত্র দেবার প্রতিশ্রুতি না দিত তাহলে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি একটা সমঝোতা সূত্রে রাজি হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়াকে জব্দ করতে ইউক্রেনকে দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করার ছক কষে নেয়। তারা পরিকল্পনা করে ইউক্রেনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আসলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বহুমুখী যুদ্ধটা তারাই চালিয়ে যাবে যতদিন না পর্যন্ত জর্জিয়া বা ইউক্রেনের মতো রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার সরকার পরিবর্তন করে পশ্চিমী অনুগত কারোর নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করা যায়।
তার জন্য একদিকে রাশিয়াকে ভাতে মারার জন্য অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে থাকে। রাশিয়ার অর্থনীতির মূল ভিত্তি তেল ও গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। অন্যদিকে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পালটা হিসেবে ইউক্রেনও যাতে টক্কর দিতে পারে তার জন্য ইউক্রেনকে জুগিয়ে যাচ্ছে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র এবং বিপুল অঙ্কের অর্থ। ইউক্রেন যাতে কোনও অবস্থাতেই শান্তি চুক্তির পথে না যায় তার জন্য ইউক্রেন রাষ্ট্রপতির মগজ ধোলাই করে। ফলে পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে ইউক্রেনের কিছু করার নেই। অর্থনীতি, সমর ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়লেও তারা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে আমেরিকার দিকে। বাইডেনের মর্জির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ।
দু’দেশেরই বিরাটসংখ্যক সৈন্যর মৃত্যু হয়েছে। অকালে ঝরে গেছে বহু সাধারণ মানুষের জীবন। দেশের বিপুল অংশের পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। ইউক্রেনের ৬০ শতাংশ এখন দারিদ্রের মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। ৪০ শতাংশের দিন কাটে মানবিক ত্রাণ সাহায্যের উপর নির্ভর করে। অন্যদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুচ্ছ গুচ্ছ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও বিরাট কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। ভারত ও চীনের কল্যাণে রাশিয়ার তেল বিক্রিতে কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি। রাশিয়ার যাত্রাভঙ্গ করতে পশ্চিমী দুনিয়া ইউক্রেনের নাক কেটে দিয়েছে। রাশিয়াকে টাইট দিতে গিয়ে সঙ্কট বেড়েছে ইউরোপের। রুশ জ্বালানির উপর প্রধানত নির্ভরশীল ইউরোপের দেশগুলি।
রাশিয়া সস্তায় ইউরোপকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করত। নিষেধাজ্ঞা জারি হবার পর ধাপে ধাপে রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। জ্বালানি সঙ্কটে ইউরোপের জনজীবন বিপর্যস্ত। জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে বিপুল। তার জেরে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধিও আকাশ ছোঁয়া। মার্কিন মদতে রাশিয়াকে জব্দ করতে গিয়ে ইউরোপের সঙ্কটও বেড়েছে অনেকটা।
আবার যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবার ফলে কোভিড উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার হুমকির মুখে। রাশিয়াকে পদানত করতে গিয়ে ইউক্রেনকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা হয়েছে, ইউরোপের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বকে ফেলে দেওয়া হয়েছে অর্থনীতির ঝুঁকির দিকে।
আপাত দৃষ্টিতে বিষয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ মনে হলেও এটা আসলে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে রাশিয়া, চীন সহ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশ সমূহের। আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। আমেরিকা যদি ইউক্রেনকে জোরজবরদস্তি ন্যাটো করা থেকে বিরত থাকত তাহলে ইউক্রেনে রুশ সেনা অভিযানের প্রয়োজনই হতো না।
Comments :0