সৃজন ভট্টাচার্য
ফেসবুকে একটি লেখা খুব ভাইরাল হয়েছে। আলিপুরদুয়ারে জয়ন্তীর উপর বক্সা পাহাড়ের ইতিহাস। ট্যুরিস্টরা কী কী পেতে পারেন এখানে এসে। ব্রিটিশ আমল থেকে ভুটান-রাজের চিহ্ন হয়ে অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি। এবং, এখানে সবকটা স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে এ অঞ্চলের পড়ুয়াদের, সে আশঙ্কা।
সরকার বাহাদুর। বাহাদুর তো বটেই। দিল সে দাবাং না হলে কেউ ববি হাকিমের মতো করে প্রাপ্য ডিএ চাওয়াকে ‘পাপ’ বলতে পারে? বাহাদুর বাহিনী ঘোষণা করেছেন, রাজ্যজুড়ে ৩০'র কম ছাত্রসংখ্যা যে স্কুলগুলোর, সেগুলো সব তুলে দেওয়া হবে লাটে। এই ফরমানে কোপ পড়েছে ৮২০৭টি স্কুলের উপর। ৬৮৪৫টি প্রাথমিক, এবং ১৩৬২টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল। এই ধাক্কায় বন্ধ হতে চলেছে বক্সা পাহাড়ের ৫টি স্কুলই। আপাতত রাজ্যজুড়ে আড়াই লক্ষ ছাত্রের লেখাপড়ার সুযোগ শেষ হতে চলেছে, চাকরি যেতে চলেছে স্থায়ী শিক্ষক-পার্শ্বশিক্ষক মিলিয়ে ২০ হাজার শিক্ষকের। সাধারণভাবে একটা স্কুলে ৩০০ জনের মতো পড়ুয়ার এনরোলমেন্ট হবার কথা। সে হিসাবে প্রায় ২৫ লক্ষ ছাত্র ছিটকে যাবার কথা এই স্কুলগুলি বন্ধ হলে। প্রশ্ন হলো, এত কম ছাত্র কেন?
এ বছর নজিরবিহীনভাবে পরীক্ষার্থী কমেছে মাধ্যমিকে। স্বাধীন ভারতে কোনও রাজ্যে কোনোদিন এক ধাক্কায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ হয়ে গিয়েছে, শোনা যায়নি কখনো। এই কমে যাওয়া ৪ লক্ষের মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ ফর্ম ফিলআপ করে শেষমেষ বসেনি মাধ্যমিক দিতে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সময়ে উচ্চশিক্ষায় অ্যাডমিশনের তথ্যাবলী আশঙ্কার উদ্রেক ঘটিয়েছিল সকলের।
এমনিতে উচ্চশিক্ষায় সিট কাট, এবং তার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রের ভর্তির সুযোগ তৈরির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন পরিচিত ঘটনা। সম্ভবত বহুদিনের মধ্যে এই প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গের ডিগ্রি কলেজগুলিতে অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা পড়ে রইল, অনার্স বা পাশ কোর্সে ভর্তি হতে এল না বিপুল অংশের ছাত্র। যদিও সাম্প্রতিককালে যাদবপুর বা শিবপুরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিতে এই দৃশ্য মাঝেমধ্যে দেখা গিয়েছে, তবুও, উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে এমন শিউরে ওঠার মতো সিট ফাঁকা থেকে যাওয়া বিরল।
ছাত্র কমছে। বিশেষত অনগ্রসর, প্রান্তিক, দরিদ্র এলাকায়। পাল্লা দিয়ে কমছে প্রস্তাবিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পুরানো স্কুলগুলি বন্ধ হচ্ছে যেমন, ঘোষণা হওয়া গাদাগুচ্ছের নতুন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়েরও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না বিশেষ। ২০১৭-১৮’র তুলনায় ২০২০-২১’এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকাশিত আর্থিক সমীক্ষায় কমে গিয়েছে ৬৫৩টি কলেজ এবং ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়। যারা টিকে আছে, তাদেরও অবস্থা সঙ্গীন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র, অধ্যাপক, পরিকাঠামো, ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং সবারই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি হাল।
পুরানোগুলো ভুগছে বেনিয়ম, দুর্নীতি বা অর্থসঙ্কটের গেরোয়। একদিকে কলকাতা বা উত্তরবঙ্গের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য সঙ্কট, অপরদিকে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হাত পাততে হচ্ছে প্রাক্তনীদের কাছে। লাগামছাড়া ফি বৃদ্ধি, সিবিসিএস’র বিটকেল নিয়মগুচ্ছের যাঁতাকল, অ্যাডমিশনে দুর্নীতি, হস্টেল-স্কলারশিপের সমস্যা ইত্যাদি পরিচিত গোলমাল তো আছেই। সব মিলিয়ে, জটায়ু উপন্যাস লিখতেই পারতেন স্বচ্ছন্দে, হরেনডাস হায়ার স্টাডিজ!
বাহ্য সমস্যাটা কী। ড্রপ আউট। লক্ষ লক্ষ ড্রপ আউট হয়েছে লকডাউনের সময়ে। কোভিড প্যান্ডেমিককে ব্যবহার করে (হ্যাঁ, ব্যবহার করেই) আমাদের মহামান্য সরকারদ্বয় চেয়েছে পাবলিক এডুকেশন সেক্টরকে ধ্বংস করে ফেলতে চিরতরে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে দরিদ্র প্রান্তিক অংশের ছাত্রদের লেখাপড়া করানোর দায় একেবারে ঝেড়ে ফেলেছে, আর অপরদিকে বাইজুস, আনঅ্যাকাডেমি বা টিউটোপিয়াদের লাগামহীন মুনাফা করিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার শ্রেণিগত অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।
বহুবার সমাজের বহু অংশ থেকে এই কথাটা সামনে আনার চেষ্টা হয়েছে, লক্ষ কোটি দরিদ্র ছাত্রের ভবিষ্যৎ চিরকালের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে এতদিন ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার ফলে, এদের পঠনপাঠনের বিকল্প ব্যবস্থা প্রস্তুত করা প্রয়োজন অবিলম্বে। অন্তত প্যান্ডেমিক শেষে আবার স্কুলছুটদের ক্লাসে ফেরানোর জন্য মাইক্রো স্তরে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কাজটুকুও যদি করা যেত, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না আমাদের। আসল কথা হলো, সরকার চায়নি। সরকার চায় না গরিব ঘরের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করুক। মোদী মমতারা সকলের জন্য শিক্ষার প্রশ্নটিকে অনাবশ্যক মনে করেন।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০'র প্রেসক্রিপশন মেনেই চলছে এরাজ্যের শিক্ষা-প্রশাসন। মাঝে চেষ্টা হয়েছিল এ রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোকে পিপিপি মডেলের নাম করে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার। প্রবল জনমতের চাপে সে সিদ্ধান্ত থমকে যাওয়ার কিছুদিন পর এখন ৮২০৭টি স্কুল বন্ধের ফরমান। একেবারে মোদীর রেসিপিতে মমতার রান্না। যেভাবে ব্যাঙ্ক মার্জার বা অ্যাকুইজিশন হয়, সেভাবেই প্রান্তিক এলাকার স্কুল সব তুলে দিয়ে সদর এলাকায় থাকবে একটিই মডেল স্কুল। গালভরা নাম, মডার্ন স্কুল কমপ্লেক্স। ফি হবে জবরদস্ত, স্কুল চালাবে আদানির ছানাপোনারা।
সেখানেই আগামী প্রজন্মকে আরএসএস’র ফরমুলা অনুযায়ী শিখতে হবে শিক্ষার নামে। এখনই যখন একদিকে সরকারি স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বস নামছে হুড়মুড়িয়ে, তখনই ব্যাপক আকারে একল বিদ্যালয় আর সরস্বতী বিদ্যামন্দিরের রমরমা বাড়ছে বাংলার গ্রামাঞ্চলে। খবর আসছে, ছাত্রের নাম এনরোলড হয়ে আছে সরকারি স্কুলে, কিন্তু সেখানে শিক্ষক নেই, ক্লাস হয় না। তাকে ধরে আরএসএস নিজের স্কুলে পড়াতে নিয়ে চলে গেছে। ডিআই’কে রিপোর্ট করলে তিনি বলছেন, থাক না, পড়াশোনা করা নিয়ে তো কথা, যেখানে পারছে পড়ুক....
একটা বড় অংশের ছাত্রকে সরকার সাফল্যের সাথে বুঝিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, যে লেখাপড়া করে কিছু হবে না। চপ বা পকোড়া ভাজাকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্তসুলভ ব্যঙ্গোক্তির বাইরে গিয়েও এর অভিঘাত সুদূরপ্রসারী। লেখাপড়া করার উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানার্জন, পরবর্তীতে কাজ অর্জন। ধীরে ধীরে জ্ঞানলাভের প্রশ্নটি সঙ্কুচিত হয়ে গিয়ে কাজ জোটানোটাই মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়ালো শিক্ষালাভের। এখন সেখানেও ভাটা।
লেখাপড়া করে সোজাপথে কোথাও কোনও কাজ নেই। ইনকাম করতে গেলে লেখাপড়া করার চেয়ে তৃণমূল করা ঢের বেশি লাভজনক বরং, পার্থ-মানিকরা সেই বার্তাই দিয়েছেন শিক্ষাক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে বসে থেকে। ধান্দাবাজির পুঁজি যেন তেন প্রকারেণ লুট চায়, সে সাবেক ধনতন্ত্রের অনেক নিয়মই মানে না। অদক্ষ শ্রমিকে ভরে থাকলে চারিপাশ, মালিকের ফূর্তি দেখে কে! সাধারণ মানুষের মনোজগতে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তা ফলত, দার্শনিকভাবেই কমিয়ে আনা হয়েছে সমাজে। এ বড় স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি নয়। সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার দিকে আরও এক ধাপ এগচ্ছে আগামী প্রজন্ম। ইঙ্গিত ভালো নয়।
বিচ্ছিন্ন করতে হবে আগামীকে। ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে। গরিব মধ্যবিত্ত ভারতীয়কে লেখাপড়া করানো যাবে না। যে কতিপয় ছাত্র লেখাপড়ার চৌকাঠ অবধি পৌঁছাবে, তাদের সমাজ রাজনীতি সংস্কৃতি অর্থনীতি দর্শন মূল্যবোধ ইত্যাদি কিচ্ছু নিয়ে বেশি ভাবতে দেওয়া যাবে না। ছাত্র রাজনীতি সব্বোনাশা, ওসব ইউনিয়নবাজি অপেক্ষা অধ্যয়নং তপঃ ইত্যাদি অনেক জরুরি। সুতরাং, ছাত্র রাজনীতির অধিকার অবরুদ্ধ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ইলেকশন নয়, সিলেকশন। ছাত্র রাজনীতির নামগন্ধ শুনলে বহিষ্কার তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা কতশত শিক্ষালয়ে।
কে বোঝাবে, ছাত্র রাজনীতির কাজ মন তৈরি করা, মনন তৈরি করা। ‘সমাজবদ্ধ মানুষ’ হিসাবে গড়ে তোলা ব্যক্তিছাত্রকে। লেখাপড়ার সাথে তার কোনও বৈরিতা নেই, বরং সিরিয়াস ছাত্র রাজনীতির কর্মীর কাছে লেখাপড়া করার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।
বাংলার ক্যাম্পাসগুলো অন্যভাবে ভাবে। মোহন ভগবাতদের উলটোপারে, বিড়লা-আম্বানি রিপোর্টের নিগড় ভেঙেই বাংলার ক্যাম্পাসগুলো লেনিন আর লালনকে বুকে রেখে বেঁচে আসছে আজ বহুকাল।
আরএসএস’র দালাল, মাননীয়া দেবী দুর্গতিনাশিনী, ছাত্রভোটে আটান্ন বছর বয়সি ছোট ছোট গুন্ডা লেলিয়ে দিলেন প্রথমে। সুদীপ্ত-স্বপন-সৈফুদ্দিনরা মরে রক্তবীজের ছাপ রেখে গেল ক্লাসঘরে আর কমনরুমে। রাজ্যজুড়ে শেষ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নে ভোট করানোর সাহস দেখিয়েছিলেন ২০১৭ সালের শুরুতে। বিপুল গুন্ডামি, বহিরাগতদের দাপাদাপির মাঝেই মশালের আলো জ্বলেছিল বেশ কিছু ক্যাম্পাসে। তারপর একদিন বললেন, নির্বাচিত ইউনিয়ন নয়, কর্তৃপক্ষের সাথে মিলিজুলি করে ছাত্র কাউন্সিল বানিয়ে দেব।
রাস্তার আন্দোলনে আটকে গেল কারসাজি, চাপের মুখে ইউনিয়নের ভোট করতে বাধ্য হলেন প্রেসিডেন্সি আর যাদবপুরে। দু’জায়গাতেই হইহই করে জিতল এসএফআই। ব্যস, গল্প শেষ। তারপর থেকে আজ অবধি আর ছাত্র ইউনিয়নের ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে উঠতে পারেনি তৃণমূল। মাঝে ব্যর্থ শিক্ষামন্ত্রী পালটে এসেছেন নতুন নাটকের কুশীলব, আরও ব্রাত্য হয়েছে লেখাপড়ায় গণতন্ত্রের সম্ভাবনা।
৬ বছর আগে শেষ যেবার ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছিল রাজ্যজুড়ে, তখন মহেন্দ্র সিং ধোনি ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন। তাঁর পরে বিরাট কোহলি, শিখর ধাওয়ান হয়ে রোহিত শর্মাও অধিনায়কত্ব ছাড়ার মুখে। এরমধ্যে ট্রাম্প উবে গেছেন, শাহরুখ ফর্মে ফিরেছেন, মেসি বিশ্বকাপ জিতেছেন— পিসি কেবল ছাত্রভোটটা করিয়ে উঠতে পারেননি।
সরকারি স্কুল বন্ধ আটকাতে হবে। ড্রপআউট ছাত্রদের লেখাপড়ায় ফেরাতে হবে। চাকরিচোরদের জেলে পুরে যোগ্য শিক্ষকদের কাজ দিতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লেখাপড়া তর্কবিতর্কের চাষজমি বানাতে হবে। ছাত্রদের দেশদুনিয়া নিয়ে কথা বলা অধিকার দিতে হবে। ছাত্রসংসদ ভোট, অবিলম্বে করাতে হবে।
১০ই মার্চ, বিধানসভা অভিযান। সরকারি কর্মচারীরা পাওনা ডিএ’র দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছেন। তাঁদের লড়াইয়ের প্রতি পূর্ণ সংহতি জানিয়েই রাস্তায় নামবে এসএফআই। গরিব ছাত্রের স্কুল বাঁচাতে। মধ্যবিত্তের শিক্ষার সুযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতে। কথা বলার ইউনিয়ন চাইতে। শিক্ষা, গণতন্ত্র, অধিকার— এই শব্দগুলোর জোর, আরেকবার মনে করাতে।
মোদীর রেসিপি। মমতার রান্না।
১০ তারিখ কড়াই উলটে দেবে ছাত্ররা।
Comments :0