Kajol Shah

লুটের নয়া কায়দা, বালিঘাটের শেয়ারের নামে প্রতি ঘর থেকে টাকা তুলেছে কাজল

রাজ্য

হাউ হাউ করে কাঁদছেন সৌদা বিবি। অভাবে জেরবার মহিলা বাড়তি কিছু টাকার লোভে পা দিয়েছিলেন তৃণমূল নেতার ফাঁদে। হারিয়েছেন সর্বস্ব। 
সিউড়ির বাঁশঝোড়ে এক নিরীহ মজদুর যুবকের খুনের ঘটনার পরদিন এই কান্না যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনই ঘরে ঘরে জমে থাকা ক্ষোভের আঁচ উগড়ে বেরোচ্ছে। 
নিশানা সেই কাজল শাহ। যে তৃণমূল নেতা শনিবার সন্ধ্যায় রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে ছবি তুলিয়েছিলেন সার্কিট হাউসে। তারপর রাতেই শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে এক নিরীহ যুবকের খুনে তৈরি হওয়া জনরোষ থেকে বাঁচাতে পুলিশ তাকে নিয়েছে হাজতে। 
এই নেতার বিরুদ্ধে কেন এত জনরোষ ? 
কষেছিলেন নিখুঁত ছক। নিজে দেদার লুটব- কিছুটা বিলিয়ে দেব। তাই গাঁয়ের ঘরে ঘরে বালিঘাটের শেয়ার দেওয়া লোভ দেখিয়েছিলেন। সেই লোভে পা দিয়েছিল বহু গরিব মানুষ। লোভ জন্মানো স্বাভাবিক। কারন তারা দেখেছেন সামান্য আনাজ ব্যবসায়ী থেকে বিশাল সাম্রাজ্যর অধিকারি হওয়া কাজল শাহকে, দেখেছেন পুলিশের সঙ্গে তার দহরম মহরম। তেমনই একজন ছাপতলার সৌদা বিবি। স্বামী রিক্সা আর ছেলে টোটো চালায়। ঘরে প্রতিবন্ধী এক ছেলে। সোমবার কাঁদতে কাঁদতে মহিলা জানান, ‘‘,পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিলাম কাজলকে। বৌমার কানের দুল আর হার বিক্রি করেছিলাম। ভেবেছিলাম দু’টো পয়সা যদি আসে, অভাব খানিক মিটবে। কি হলো দেখুন। গোটা পয়সা চোট করে দিল।’’ একদা কাজল শাহর দোসর,  বালিঘাটের অংশীদার গ্রামেরই এক যুবক খোলসা করে সবটা। বলে, ‘‘দারুন প্ল্যান করেছিল কাজল দা। পাঁচ বছর আগে সিউড়ি ১নং ব্লকের ধান্যসড়া গ্রামের ময়ূরাক্ষীর একটি বালি ঘাট লিজ নেয়। গ্রামের মানুষের কাছে জানায় পঞ্চাশ হাজার পিছু এক ভাগ করে শেয়ার দেওয়া হবে। মাসে মাসে লাভের টাকা পাবে।’’ গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, উদ্দেশ্য ছিল মানুষের টাকায় বালি ঘাট ইজারা নিয়ে বিপুল পরিমাণ কাঁচা টাকা রোজগার করা। বিনিময়ে অল্প তুষ্ট স্বল্পে খুশি গরিব মানুষগুলোকে অল্প কিছু টাকা বিলিয়ে নিজের হাতে রাখা।  প্রথমে দিকে দুবার টাকা দিয়েওছিল। তারপর থেকেই বন্ধ। যার জেরে দিশাহারা বাঁশঝোড়ের দক্ষিণ পাড়ার নুরেমা বিবি। স্বামী মাছ বিক্রি করে সংসার চালান। মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন কাজল শাহর হাতে। এই মহিলার কথায়, ‘‘ভেবেছিলাম যদি কিছু টাকা বাড়ে তাহলে মেয়ের বিয়ে ভাল করে দিতে পারব।’’ আরও বেশী বিপাকে পড়েছেন সানোয়ারা বিবি। দিনমজুর পরিবারের গৃহবধূ মাইক্রো ফিনান্স সংস্থা থেকে চড়া সূদে ঋন নিয়েছিলেন। এই মহিলার কথায়, ‘‘একবার ৩৫০০ ও আরেকবার ১৫০০ টাকা দিয়েছিল। তারপর থেকে বন্ধ। এদিকে লোন নেওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য প্রতি সপ্তাহে ১২৫০টাকা গুনতে হচ্ছে। ৫২ সপ্তাহ কিস্তি দিতে হবে।’’দিনের পর দিন টাকা দেওয়ার নামগন্ধ না করায় ধীরে ধীরে মানুষের ক্ষোভ চড়তে থাকে কাজল শাহর বিরুদ্ধে। মানুষ খোঁজখবর করতেই বেরিয়ে আসে, যে ঘাটের কথা বলে টাকা তোলা হয়েছিল সেই ঘাটের ইজারা বাবদ টাকা তিন কিস্তিতে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হয়। কিন্তু এই ঘাটের ক্ষেত্রে প্রথমবারের কিস্তি জমা পড়লেও তারপর আর কোনও টাকা জমা পড়েনি। ফলে ঘাট থেকে বালি তোলার অনুমতি বাতিল হয়ে যায়। এরপর গ্রামে ক্ষোভ চরমে ওঠে। ফলাফল, একসময় গাঁয়ের শেষ কথা কাজল শাহের বিরুদ্ধে হয়ে একদা তারই অনুগামীরা। তার জেরেই গ্রামে শুরু হয় দুই পক্ষের অশান্তি। যার সর্বশেষ পরিণতি সবজির পাইকারি বাজারে মুটিয়ার কাজ করা এক নিরীহ তরতাজা প্রাণের নৃশংস খুন। জনরোষে খোদ গ্রামের তৃণমূল সদস্যের বাড়িতেও চলে ভাঙচূড়। সোমবার গ্রামে গিয়েছিলেন পুলিশ সুপার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠি। বলেছেন, ‘‘গ্রামে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করা হচ্ছে। প্রতিদিন টহল জারি থাকবে। ২৫টি তাজা বোমা উদ্ধার হয়েছে।’’
এদিকে  টাকা ফেরত না পেয়ে মানুষ যখন ধুঁকছে, তখন এই কাজল শাহ তৈরি করছে প্রাসাদোপম বাড়ি। যার নির্মাণ শেষ পর্যায়ে। সেই বাড়ির পেছনেই বাস করা রাজমিস্ত্রি রমজান, নজ শেখ, ইঁটভাটার শ্রমিক মেহের সকলেই টাকা দিয়ে প্রতারিত। এদিন তারা কাজল শাহর অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়েই উগড়েছেন ক্ষোভ, ‘‘গ্রামে কমকরে তিনশো জনের কাছ থেকে টাকা তুলেছিল। সেই মানুষগুলো টাকা না পেয়ে তড়পাচ্ছে আর  নেতা মহল বানাচ্ছে কে মানতে পারবে বলুন?’’ তাই তো যে মহলের ব্যালকনি থেকে গ্রাম শাসন করবে ভেবেছিল কাজল, চারপাশের ক্ষোভের আঁচে সেই মহল এখন পুলিশের ঘেরাটোপে। ঘটনা আবার জন্ম দিয়েছে অন্য আশঙ্কারও। মানুষের ক্ষোভে আঁচে সলতে পাকিয়ে এক কাজল হঠে নতুন কোনও কাজলের জন্ম হবে না তো!
 

Comments :0

Login to leave a comment