৩০ মার্চ। রাম নবমীর মিছিলের নামে হাওড়ার শিবপুরের পিএম বস্তি অঞ্চলে ধর্মীয় অশান্তি পাকায় বজরঙ দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। রাস্তার উপরে সার দিয়ে দোকান ভাঙে উত্তেজিত জনতা। অধিকাংশই গরিব কিংবা মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের দোকান। রমজানের সময় ফলের পসরা সাজিয়ে বসা ফেরিওয়ালার ঠেলা গাড়ি মাঝরাস্তায় মজুত করে আগুন লাগানো হয়েছে। লুঠ হয়েছে মাংসের দোকান। সর্বস্ব পুড়েছে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরই।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অটোগুলিকে খেলনা গাড়ির মতো ভাঙা হয়েছে। অটো চালকের আক্ষেপ, মালিক বলছে আমি কি বলেছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঙ্গা দেখতে? তোমাকে নিজের পয়সায় গাড়ি মেরামত করাতে হবে। কী ভাবে করবে আমার দেখার প্রয়োজন নেই।
এলাকার মানুষ প্রথম থেকেই রামনবমীর দিন অশান্তির আশঙ্কা করেছিলেন। ‘আমন’ নামে এলাকার বিশিষ্টদের একটি সংগঠনের তরফে ২৬ মার্চ পুলিশকে ডেপুটেশন দিয়ে এলাকায় শান্তি রক্ষার আবেদন করা হয়। পুলিশও বলেছিল, যাই হয়ে যাক, এলাকার শান্তি বিঘ্নিত হবে না। বহুতলগুলিতে পুলিশি নজরদারি থাকবে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।
সেই ‘কথা’ও পুলিশের তরফে রাখা হয়নি। ৩০ মার্চের ঘটনার দিনে এলাকার কোনও বহুতলের ছাদেই পুলিশ মোতায়েন ছিল না। এলাকার বাসিন্দাদের আক্ষেপ, থাকলে এতবড় ঘটনা ঘটতে পারত না।
রবিবার শিবপুরের ঘটনার প্রতিবাদে এলাকায় শান্তি মিছিলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বামপন্থীরা। ১৪৪ ধারা জারি থাকার ‘অজুহাতে’ পুলিশ মিছিলের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। পুলিশি আচরণের প্রতিবাদে সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা কমিটির অফিসের সামনে বিক্ষোভ সভা হয়।
এদিনের সভা থেকে সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্ট এবং বাম ও সহযোগী দলগুলির তরফে বারবার একটি প্রশ্নই তোলা হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দলের মতো সংগঠনগুলি অস্ত্র নিয়ে মিছিলের অনুমতি পেলে, বামপন্থীরা শান্তি মিছিলের অনুমতি কেন পাবেন না?
পিএম বস্তির ঘটনার পরে মমতা ব্যানার্জি রেড রোডের ধর্ণা মঞ্চ থেকে বলেছিলেন, বজরঙ দল পুলিশের অনুমতি ছাড়াই রামনবমীর মিছিল করেছিল। সেই দাবি এদিনের সভা থেকে স্পষ্ট ভাষায় নাকচ করে দিয়েছেন মহম্মদ সেলিম।
সেলিম বলেছেন, ‘‘ আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। মার্চ মাসের গোড়া থেকে বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদি সংগঠনগুলির তরফে পুলিশকে দফায় দফায় মেইল করেছিল। পুলিশের তরফে বেশ কিছু শর্তের বিনিময়ে মিছিলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এখন মমতা ব্যানার্জি মিথ্যা কথা বলছেন, যে পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল হয়েছে।’’
হাওড়া জেলা সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ জানাচ্ছেন, ২০২২ সালের রামনবমীর মিছিল থেকেও একই কায়দায় উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের তরফে উদ্যোক্তাদের বলা হয়েছিল, এবার অস্ত্র নিয়ে কোনওভাবেই মিছিল করা যাবে না। এর পাশাপাশি সংগঠনের সদস্য নয়, এমন ব্যক্তিদেরও মিছিলে রাখা যাবে না। নমাজ শুরু হওয়ার আগে, অর্থাৎ সাড়ে পাঁচটার মধ্যে মিছিল শেষ করতে হবে। পুলিশের জানায় যে, সেই শর্তে উদ্যোক্তারা রাজি হওয়াতেই মিছিলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ৩০ তারিখ কোনও শর্তই মানা হয়নি পুলিশের। এলাকার মানুষের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃত ভাবে নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘন্টা পরে মিছিল শুরু হয়। প্রচুর মানুষও জমায়েত হয় মিছিলে। বহু সংখ্যাক যুবকের হাতে অস্ত্রও দেখা যায়। সব মিলিয়ে হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের বেঁধে দেওয়া একটি শর্তও মানেনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল সহ বাকি উদ্যোক্তারা।
কিন্তু তারপরেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শর্ত খেলাপের ফলে এলাকার আইন শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে, তা কি বুঝতে পারেন নি পুলিশের আধিকারিকরা? নাকি, ইচ্ছাকৃত ভাবেই মিছিলকে এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছিল সেদিন?
এদিন মহম্মদ সেলিমের বক্তব্যেও উঠে এসেছে সেই কথা। তিনি বলেন, ‘‘ বামপন্থী ছাত্র যুবদের মিছিল আটকাতে পুলিশ রোবো কপ, টিয়ার গ্যাস, লোহার ব্যারিকেড ইত্যাদি ব্যবহার করে। তাতেও কাজ না হলে স্রেফ লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। ৩০ মার্চ দাঙ্গাবাজদের আটকাতে রোবো কপদের ব্যবহার করা হল না কেন?’’
মমতা ব্যানার্জি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার নেপথ্যে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা রয়েছে।
এদিনের বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম)’র পলিটব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য সহ শীর্ষ বামপন্থী নেতৃত্ব।
সূর্য মিশ্র সরাসরি বলেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না। একথা জ্যোতি বসু বলে গিয়েছেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার চাইছে দাঙ্গা হোক, তাই দাঙ্গা হচ্ছে।
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেন, মানুষকে ভরসা যোগানোর জন্য পিএম বস্তিতে যেতে চেয়েছিলাম আমরা। পুলিশ দাঙ্গাবাজদের মিছিলের অনুমতি দিলেও আমাদের আটকে দিল। তিনি উপস্থিত জনতার কাছে আহ্বাণ করেন, জেলার যেখানে যেখানে ১৪৪ ধারা জারি নেই, সেখানে শান্তি মিছিল করুন। মানুষের মধ্যে সাহসের সঞ্চার করতে হবে। দাঙ্গাবাজদের পরাজিত করতে হবে মানুষকে একজোট করে।
এদিনের সভা পরিচালনা করেন হাওড়া জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক দিলীপ ঘোষ। সভায় বক্তব্য রাখেন ফরওর্যাড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জী , সিপিআই’র জেলা সম্পাদক বিদ্যুৎ গাঙ্গুলি, আরসিপিআই নেতা মিহির বাইন, সমর কুন্ডু , প্রবীর ঘোষ প্রমুখ।
Comments :0