ইন্দ্রজিৎ ঘোষ
পাড়ার বয়স্কদের আড্ডায় জোর কদমে আলোচনা পাড়ার মেয়ে বউগুলো উচ্ছন্নে গেছে। তাদের আলোচনায় আসছে পাড়ার মেয়ে বউগুলো প্রতিদিন নতুন নতুন ছেলের বাইকে বাড়ি ফেরে।
কেউ তো যায় একজনের যাথে ফেরে আর এক জনের সাথে। এই সব আলোচনা থেকে বাঁচতে অনেকে আবার পাড়ার কিছুটা আগেই বাইক ট্যাক্সি থেকে নেমে যায়।
কয়েকদিন পর ওই আড্ডা ঠেকে বিষয়টি আবার উঠতে তখন খোলসা হলো এইগুলো নাকি বাইক ট্যাক্সি।
বাস অটো ট্যাক্সির মতো বাইকের পিছনের সিটে একজনকে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। নিজের বাইক নিয়ে ভাড়া খাটে। রোজগারও হয়।
বেকার ছেলে বসে না থেকে এইভাবে অনেকেই ইনকাম করছে। কেবল ছেলেরা নয় অনেক মেয়েরাও স্কুটি নিয়ে বা বাইক নিয়ে বাইক ট্যাক্সি চালাতে নেমে পড়েছে। কলেজ পড়ুয়া, হস্টেল, মেসে থাকে, এইরকম যুবক যুবতীরাও এই কাজের সাথে যুক্ত হয়েছে। অনেকে অফিস যাতায়াত এর পথে ও অ্যাপ ব্যবহার করে যাত্রী পরিবহণের সাথে যুক্ত হয়েছেন। কোনও একটি সংস্থা থেকে হঠাৎ কাজ চলে যাওয়ার পর কিভাবে উপার্জন করব ভেবে না পেয়ে বাইক চালাতে জানা থাকলে ও নিজের বাইক বা স্কুটার আছে সে ও বাইক ট্যাক্সি চালাতে শুরু করে দিলো।
গণপরিবহণে এই যানের ব্যবহার সাম্প্রতিক।
দু’চাকার বাইক ট্যাক্সি। ওলা, উবের, র্যা পিডো, ইন্ড্রাইভ, যাত্রীসাথী এই সমস্ত অ্যাপ আছে যেখানে লগ ইন করেই এই ধরেনের কাজের যাথেই যুক্ত হওয়া যায়।
আপনি বাড়িতে বসে আছেন, বৃষ্টি হচ্ছে বা খুব রোদ, অনেক রাত, বা অসুস্থ আপনাকে খাবার আনতেই হবে। বা বন্ধু আত্মীয়দের কিছু পাঠাবেন, কোনও চাপ নেই। আপনি জোম্যামটো, ব্লিংকিট সুইগি,... তে বুক করে খাবার আনাতে পারেন, পোটার, অ্যামাজন... অসংখ্য অ্যাপ আছে যার মাধ্যমে আপনি আপনার চাহিদা মেটাতে পারেন।
বাইক ট্যাক্সি চালকদের মতই অনেকে নিজের পছন্দের বাইক বা সাইকেল নিয়েই এক কাজ করে যাচ্ছে।
বেকারত্বের যন্ত্রণা নিয়ে এরকম বাইক ট্যাক্সি চালাচ্ছে বা ডেলিভারির কাজে যুক্ত আছে তারা ব্যাপক যন্ত্রণার মধ্যে আছে।
আমাদের অনেকেই অ্যাপ-এর মাধ্যমেই গাড়ি বা খাবার বুক করে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে যাত্রীর লোকেশানে বাইক নিয়ে পৌঁছে যান বাইক ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে যান ক্যাপ্টেন। মানে চালক।
এবং যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেন।
ভাড়া অনলাইনে বা ক্যাশ দিতে পারেন।
র্যা পিডো, ওলা, উবের, ইনড্রাইভ এই অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলির মূল কাজ হলো যাত্রীদের সাথে বাইক ট্যাক্সি চালকের সংযোগ করানো।
এর বিনিময়ে ব্যাপক পরিমান কমিশন কেটে নেয়।
সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২০% কমিশন কাটার কথা কিন্তু ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন কাটে।
বাইক, বাইকের তেল, বাইকের মেন্টেনেন্স বাইক ট্যাক্সি চালকের, অ্যাপ ক্যাব কোম্পানিগুলো কেবলমাত্র ভাড়া ঠিক করে দিয়ে ৪০ শতাংশ কেটে নেয়।
এমন ভাবেই খাবার ও পৌঁছে দেয় রোদ ঝড় বৃষ্টি ঠান্ডাকে উপেক্ষা করেই।
কিন্তু আশ্চর্য বিষয় ওলা, উবের, র্যা পিডো, ইন্ড্রাইভ, যাত্রীসাথী, সুইগি, জোম্যা টো ব্লাংকিট, এমাজোন বা পোটার কেউই এদের সেই কোম্পানির শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না।
তারা বলে তারা হলো কোম্পানির পার্টনার।
এক চরম দ্বিচারিতা, বিশ্বাসঘাতকতা যুব সমাজের সাথে।
প্রখর রোদে, ব্যাপক বৃষ্টিতে, শীতের সকালে বা শীতের রাত্রে ব্যাপক ঠান্ডায়, নিজের পেটের দায়ে বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে যে সমস্ত যুবক-যুবতীরা এই কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে তাদের সাথে চরম বঞ্চনা।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে পুঁজিপতিরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবে এবং মুনাফার পরিমাণ বাড়াবে, শোষণের মাত্রা তীব্র করবে, করবে এটাই মার্কসবাদের শিক্ষা।
এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর পার্টনার।
না হাসি পাওয়ার কিছু হয়নি এই নামটা না দিলে এই কোম্পানির শ্রমিক হিসাবে মান্যতা দিতে হবে। এই কোম্পানিগুলোর মুনাফার মূল কারিগর এরাই।
কিন্তু তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই বেনিফিট, সামাজিক সুরক্ষা এগুলো থেকে বঞ্চিত করতে হবে। তাই পোশাকি নাম ড্রাইভার পার্টনার বা ডেলিভারি পার্টনার ।
এই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে গিগ ওয়ার্কার্সদের প্রচুর ক্ষোভ থাকলেও তারা সংগঠিত হতে পারছিল না।
তার অন্যতম কারণ এই পেশার সঙ্গে যারা যুক্ত তারা অনেকেই এই কাজটিকে মূল প্রফেশন হিসেবে দেখে না। পার্ট টাইম জব।
কয়েকদিন এই কাজ করে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজের সাথে যুক্ত হয়।
অনেকে তো লজ্জায় বাড়িতে বলতেও পারে না কি কাজ করেন। বাড়ি বা পাড়াতে অন্য কাজ করে বলে পরিচয় দেয়।
আবার ভয় আছে সংগঠিত হলে বা ইউনিয়ন করলে আইডি বন্ধ করে দেবে।
আর যেহেতু এখানে একটা অংশ পার্ট টাইম জব করে, তাদের সংগঠিত হয়ে ইউনিয়ন তৈরি করা পুলিশের বিরুদ্ধে ও কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা এই মানসিকতাও ছিলনা অনেক ক্ষেত্রে।
ক্যাব ড্রাইভারের বা ডেলিভারি ওয়ার্কারদের হঠাৎ কোনও সমস্যা হলে রাস্তায় পুলিশ ধরলে বা সবচেয়ে মারাত্মক কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে জানানোর কোনও জায়গা নেই। সবটাই অনলাইন সবটাই ভার্চুয়াল। ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে শোষণ।
প্রায় ৩ বছর আগে সিআইটিইউ'র উদ্যোগে
কলকাতা ওলা উবের অ্যাপ ক্যাব অপারেটার্স অ্যা ন্ড ডাইভারস ইউনিয়ন এই বাইক ট্যাক্সি চালকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করে ও অল ইন্ডিয়া গিগ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের মাধ্যমে ডেলিভারি ওয়ার্কারদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়েছে।
বাইক ট্যাক্সিচালকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অসুবিধা ছিল। বিশ্বাস করানো কঠিন ছিল দাবিদাওয়া আদায় করা সম্ভব।
প্রথম দিন থেকেই স্লোগান ছিল বাইক ট্যাক্সি চালকদের কমার্শিয়াল নাম্বার প্লেট দিতে হবে।
এই দাবিতে কোম্পানিগুলো এবং সরকারের কাছে আন্দোলন হয়েছে।
সরকারকে আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে বাধ্য করেছি দুই চাকার কমার্শিয়াল নাম্বার প্লেট দিতে হবে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ও ২০২৫ সালের মার্চ মাসে সরকার ক্যাম্প করে দু’চাকার বাইক ট্যাক্সি চালকদের হলুদ নাম্বার প্লেট দিয়েছে।
হলুদ নাম্বার প্লেট এর মাধ্যমে অ্যাপ ক্যাব কোম্পানিগুলো এখন নতুন করে আইডি খুলছে।
পুলিশ আর হয়রানি করতে পারবে না।
গরিব কম বয়সি যুবক-যুবতীদের কিছুটা হয়রানি থেকে বাঁচানোর জন্য এই আন্দোলন।
আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা বলেছি অ্যাপ ক্যাব ও ডেলিভারি কোম্পানিগুলোকে ড্রাইভারদের এক্সিডেন্ট বেনিফিট দিতে হবে।
মেডিক্যা লের ইন্সুরেন্স পলিসি দিতে হবে।
যখন তখন আইডি ব্লক করা যাবে না। আইডি ব্লক করার আগে সাথে কথা বলতে হবে। গিগ ওয়ার্কার্সদের শ্রমিকের সম্মান দিতে হবে।
রাজ্য সরকারকে বাইক ট্যাক্সি চালকদের পরিবহন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
লড়াই করলে শ্রমিকদের মধ্যে ভরসা অর্জন করলে, লড়াইয়ের মাধ্যমে কিছুটা দাবি আদায় করতে পারলে শ্রমিকরা একত্রিত হয়।
শ্রমিকরা জানে একদিনে সব দাবি আদায় হবে না কিন্তু একদিন হবেই। এই বিশ্বাস এই কম বয়সি তরুণ প্রজন্মের গিগ শ্রমিকরাও মনে করে।
তারা সংগঠিত হচ্ছে লড়াইয়ের মাধ্যমে।
রাজ্য সরকার দেশের সরকার যতই অসহযোগিতা করুক যতই মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির দালালি করুক গিগ ওয়ার্কার্সরা কোম্পানির শোষণের বিরুদ্ধে সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার বুঝে নেবে এটাই আজকের শপথ।
আগামী ২০ তারিখে এই প্রজন্মের শ্রমিকরাও ব্রিগেড সমাবেশে যুক্ত হবে নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে।
Comments :0