বিশ্ব জুড়ে জালিয়াতি ও কারচুপিতে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে অর্থ লোপাট করা আদানি ভাইদের পুরানো অপরাধ। তবু আদানির শেয়ার কেলেঙ্কারির তদন্তে নীরব কেন মোদী? ‘হাম আদানি কে হ্যায় কৌন’ বলে এখন আর মোদীর আদানি-প্রীতি আর গোপন করা যাবে না। আদানি শেয়ার কেলেঙ্কারিতে তদন্তের দাবি জানিয়ে এই প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস। সোজা প্রশ্ন, কোথায় গেল মোদীর অর্থনৈতিক অপরাধীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা? মোদী ঘনিষ্ঠ আদানি ভাইদের কারচুপিতে শেয়ার বাজারে দর বাড়ানোর পুরানো অপরাধের কথা তুলে ধরেছে কংগ্রেস। গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানির নাম উঠে এসেছে পানামা পেপারের বিশ্ব জোড়া অর্থ পাচার কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশে।
প্রসঙ্গত, আজ থেকে সাত বছর আগে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল পানামা পেপারস বিশ্বের বিভিন্ন করমুক্ত দেশে বেআইনিভাবে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা যে বিপুল অর্থ মজুত করছে তা উল্লেখ করে রিপোর্ট প্রকাশ করে। ভারতে এই কর্পোরেটদের মধ্যে ছিল আদানি গোষ্ঠী। হিন্ডেনবার্গ যে পদ্ধতিতে শেয়ারের দর কারচুপি ও জালিয়াতিতে বাড়িয়ে অর্থ লোপাট করার কথা জানিয়েছে, সেই পদ্ধতিতে সাত বছর আগে আদানি গোষ্ঠীর একই ভাবে অর্থ লোপাটের খবর প্রকাশ হয়। এই কেলেঙ্কারিতে সরাসরি আদানি ভাই বিনোদ আদানির সেল কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে করমুক্ত দেশে মজুতের খবর প্রকাশ হয়। পানামা পেপারে কর্পোরেটদের বিপুল অর্থ পাচারের খবর ফাঁস হওয়ায় বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় পড়ে যায়। বিভিন্ন দেশ এতে তাদের দেশে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। ভারতে ছাড় পেয়ে যায় আদানি গোষ্ঠী। তাদের জালিয়াতির কারবার যথারীতি চলতেই থাকে। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে সেই আদানির গোষ্ঠীর পুরানো শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। মোদী ক্ষমতায় থাকায় তার প্রিয় আদানি গোষ্ঠীর আদানি ভাই বিনোদ আদানি ছাড় পেয়ে গিয়েছেন। এবারেও দেখা যাচ্ছে, আদানির কারবারে বেআইনি কিছু দেখছেই না মোদী সরকার। তাই বিরোধীদের স্পষ্ট, কথা মোদী আদানির কেউ নয় বলে অজুহাত দিয়ে কিন্তু ছাড় পাবে না।
এদিকে, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানির গোষ্ঠীর শেয়ারের দর নিয়ে জালিয়াতি খবর ফাঁস হওয়ার পর থেকে তার শেয়ার দর পড়তে থাকে। মাঝে আদানি গোষ্ঠী নতুন শেয়ার বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকা তোলার উদ্যোগ নিলেও শেয়ার দর পড়ে যাওয়াতে নতুন শেয়ার বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা নতুন শেয়ার কিনেছে তাদের শেয়ার ফেরত নিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফের বন্ড বিক্রি করে ১ হাজার কোটি টাকা তোলার সিদ্ধান্ত হলেও দর না মেলায় তাও বাতিল করে আদানি গোষ্ঠী। মাত্র সাত দিনে শেয়ারে দাম কমে বাজার থেকে ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা উধাও হয়ে গিয়েছে। এই শেয়ারের সিংহভাগ অংশের ক্রেতা হলো রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থা। ফলে আদানির থেকে লোকসান বেশি দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থার। তারা মোদীর নির্দেশে চড়া দামে আদানির শেয়ার কিনে এখন লোকসানে ডুবছে।
আদানির গোষ্ঠীর কারচুপি জালিয়াতিতে শেয়ারের দর বাড়িয়ে টাকা লোপাটে কোন অপরাধ দেখছে না মোদী সরকার। মোদী প্রিয় আদানির হয়ে সাফাই গাইতে তাই নেমে পড়েছেন বড় বড় মন্ত্রীরা। এদিন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন, এই শেয়ার দর কমে যাওয়া হলো একটি সংস্থার (পড়ুন আদানি) নিজস্ব সমস্যা। তারা নিজেরাই তা মিটিয়ে নেবে। এতে কেন্দ্রের আলাদা তদন্তের কোনও দরকার হবে না বলে তিনি বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন, দেশে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সেবি’র মতো প্রতিষ্ঠান আছে। তারা জানে কী করতে হবে। আশা করি এতে কিছু করার থাকলে নিশ্চয় তারা নিশ্চয় করবে। অর্থমন্ত্রীর আরও দাবি, আদানির ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে কোনও প্রভাব ফেলবে না। তিনি জানান, আদানির শেয়ারের দর কমার ঘটনার পর বিদেশি লগ্নি দেশে আসছে। তাই স্বচ্ছন্দেই বলা যায় আদানির ঘটনায় অর্থনীতির কোনও ক্ষতি হবে না। আদানি শেয়ারের দাম কমায় রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থার কোনও ক্ষতি হবে না বলেও এদিন দাবি করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আদানির মতো সংস্থায় যে পরিমাণ অর্থ লগ্নির সীমা রয়েছে সেটুকু লগ্নি হয়েছে। শেয়ার দর ধসে গেলেও এতে সংস্থার আর্থিক ক্ষতি হবে না বলে দাবি অর্থমন্ত্রীর। বিজেপি’র আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত আদানির সাফাই গেয়ে বিবৃতিতে বলেছেন, আদানির শেয়ার দর ওঠা নামা প্রতিদিনের বিষয়। এতে অর্থনীতির কোনও ক্ষতি হয় না। সকলেই বিশ্বাস করেন মোদীর নেতৃত্বে দেশ চলছে তাই, কিছু শেয়ারের দর কমলে দেশের অর্থনীতির কোনও ক্ষতি হবে না।
মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী থেকে একের পর এক মন্ত্রীরা আদানির শেয়ারে ধস নামায় কোনও গুরুত্ব দিতে না চাইলেও ধস নামায় বিরতি দেখা যাচ্ছে না। আদানির শেয়ার দর নিয়ে জালিয়াতি কারচুপির রিপোর্ট প্রকাশের পর ২৪ জানুয়ারি থেকে আদানির শেয়ারে ধস নেমে বাজার থেকে উধাও হয়েছে ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা। আদানি গোষ্ঠীর সাতটি সংস্থায় শেয়ারের দাম কমেছে গড়ে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ হারে। মোদীর নির্দেশে আদানির শেয়ারের মূল ক্রেতা হলো রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থা। তারা চড়া দামে আদানির শেয়ার কিনতে বাধ্য হয়েছে। যেমন দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা জীবন বিমা নিগম (এলআইসি)। তাদের আদানি গোষ্ঠীর সাত সংস্থায় মোট ৮১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার শেয়ার চড়া দামে কিনতে হয়েছে। দর কমতে থাকায় সেই শেয়ারের দাম কমে হয়েছে ৪২ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা, সোজা হিসাবে লোকসান হয়ে গেছে ৩৮ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। আদানি টোটাল গ্যাস আদানি পোর্ট এবং আদানি এন্টারপ্রাইজের চড়া দরে শেয়ার কিনে এই বিপুল লোকসান হয়েছে। এদিকে এই শেয়ার দর কারচুপি জালিয়াতিতে বাড়ানো হলেও এতে কোনও অপরাধ দেখেননি অর্থমন্ত্রী। ফলে তা নিয়ে তদন্তের কথাও ভাবছেন না। এদিকে এলআইসি সংস্থার মিউচুয়াল ফান্ড, তার বিদেশি লগ্নিকারক সংস্থা মিলে মোট শেয়ার কিনেছে ৩লক্ষ ৯৮ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। দর কমে সেই শেয়ারের মূল্য হয়েছে, ১ লক্ষ ৯০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এতে লোকসান মিউচুয়াল ফান্ড ও বিদেশি লগ্নিকারক সংস্থার মোট লোকসানের পরিমাণ হলো ২ লক্ষ ৭হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। অন্যান্য মিউচুয়াল ফান্ড আদানির শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করেছে ১৬ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সেই দর কমে ৮ হাজার কোটি টাকা নিচে নেমে এসেছে। ফলে মিউচাল ফান্ড সংস্থার লোকসান ৮ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। অম্বুজা সিমেন্ট ও আদানি পোর্টের শেয়ারের দর পরে যাওয়াতে তাদের এই লোকসান গুণতে হচ্ছে। এদিকে স্টেট ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অব বরোদা এবং পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ককেও আদানির শেয়ার কিনে দর পড়ে যাওয়ায় লোকসানে ডুবতে হয়েছে।
এদিকে আদানি গোষ্ঠী কারচুপি জালিয়াতিতে শেয়ার দর পড়ে যাওয়ায় যে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থাকে তা নিয়ে তিনটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন বিরোধীরা। ১) কেন কেন্দ্রের কোনও গোয়েন্দা সংস্থা আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার নিয়ে জালিয়াতি ও কারচুপি কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে না? ২) এতে নিরপেক্ষ কোনও তদন্ত আদৌ হবে কি? ৩) আদানি গোষ্ঠীর জালিয়াতি কারচুপির পর যে বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর জলের দরে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে কি কোনও তদন্ত হবে?
Comments :0