গৌতম রায়
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ভেতর দিয়ে শুধু রাজনৈতিক নয় ,সামাজিক ক্ষেত্রেও পাশবিকতার আমদানি ঘটাতে চাইছে অসভ্য বর্বর হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি আর এস এস- বিজেপি। ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা ভারতীয় সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে কার্যত মুছে দেওয়ার লক্ষ্যে, হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি ভারতীয় সমাজকে একটা ভয়ংকর খাদের কিনারায় নিয়ে আসতে চাইছে। তার ফলে ভারতের আর্থ- সামাজিক- সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক ,সমস্ত দিক থেকে অন্ধকার নেমে আসছে।
ভারতের যে প্রবহমান চরিত্র আজ কেবল বড় সংকটের সামনে এসে দাঁড়ায়নি। ভারতচেতনার অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নেমেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। রাষ্ট্র শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে যে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর আরএসএস তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এবং বিভিন্ন ধরনের শাখা সংগঠন, যেমন ; বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ,বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, দুর্গা বাহিনী ,ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের মতো শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রশক্তিকে আংশিকভাবে প্রভাবিত করে।
ভারতের সমন্বয়ী সংস্কৃতির প্রতীক, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করার সময় ভারতে যে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা ছিল, তাতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মানুষদের মধ্যে এই ধারণা প্রবল ছিল যে ; এইভাবে সাম্প্রদায়িকতার আবর্তে ভারত ডুবে যেতে পারে না। কিন্তু, সেই আবর্ত থেকে ভারতকে রক্ষা করবার জন্য বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজন ছাড়া বুর্জোয়া রাজনীতির আর একজনও যত্নবান হলেন না। ভোট রাজনীতির লক্ষ্যে আশ্রয় নিলেন নরম সম্প্রদায়িকতার। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিকল্প কখনোই নরম সাম্প্রদায়িকতা হতে পারে না।
অপরপক্ষে উদার অর্থনীতি, অর্থনেতিক সংস্কার ইত্যাদির নাম করে ভারতের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোটাকে যেভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং ব্রতী হন। তার ফলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে একটা দ্বিমুখী ধারা তৈরি হয়ে যায়। অর্থনৈতিক সংস্কারের নাম করে ভারতের বাজারকে বিদেশি বহুজাতিক, যারা মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট ,তাদের কাছে খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে নেওয়া হয়। সমাজে ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে।
আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো অংশেই পৃথক কোনো অবস্থানে অবস্থান করে না ।কিন্তু মজার কথা হলো; কংগ্রেসের এই আত্মঘাতী অর্থনীতির ফলে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় যে সংকট তৈরি হয় ,বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে যে সংকট তৈরি হয়, সেই সংকটের মোকাবিলায় প্রশ্নে বামপন্থীরা ছাড়া ভারতীয় রাজনীতির আর কোন স্তরের অংশকে যত্নবান হওয়া তো দূরের কথা, সক্রিয় হতে পর্যন্ত আমরা দেখতে পেলাম না। বাজার অর্থনীতিকে ভারতীয় রাজনীতিতে নেহরু মডেলের বিকল্প হিসেবে মনমোহন সিং তুলে ধরার ফলে ,সামাজিক ক্ষেত্রে যে ধরনের সংকট সামনে এসে দাঁড়ায়, ভারতের সাধারণ মানুষ ,বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ, তাঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু এবং দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ ,তফসিলি জাতি- আদিবাসী মানুষ, এঁদের সংখ্যাটাই ছিল সব থেকে বেশি।
বিজেপি-আরএসএস’র সামাজিক প্রযুক্তির একমাত্র লক্ষ্য হলো ; সাধারণ মানুষ, যাঁরা জন্মসূত্রে হিন্দু এবং ধর্মবিশ্বাসী হলেও ধর্মান্ধতায় বিশ্বাস করেন না, তাঁদের জীবনধারায় মুসলিম বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেওয়া। বিজেপি’র ভোট রাজনীতির অন্যতম প্রধান এই কৌশল।
বামপন্থীদের মতো যদি অ-বিজেপি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের প্রশ্নে দৃঢ় সংকল্প হত, তাহলে আজ ভারতের এই দুর্দিন আসত না হয়ত। কংগ্রেসের কাছে এক সময় সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধ করবার থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বামপন্থীদের শায়েস্তা করা, সর্বোপরি কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করা।
সেই লক্ষ্য নিয়েই প্রথম ইউপিএ সরকারের সময়ে বামপন্থীদের সমর্থনে সরকার পরিচালনা করা সত্ত্বেও, কিছু মৌলিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে, ইচ্ছাকৃতভাবে কার্যত পায়ে পা লাগিয়ে সংঘাতের পরিবেশ সেই সময়ের কংগ্রেস নেতৃত্ব তৈরি করেছিল। সাম্প্রদায়িকতাকে রুখবার প্রশ্নে ,দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাঁচিয়ে রাখবার প্রশ্নে যে দায়বদ্ধতা থেকে ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর, বামপন্থীরা কংগ্রেসকে সমর্থন জানিয়েছিলেন সরকার গঠনের প্রশ্নে, সেই সমর্থনকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হলো না।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিং প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে আগের প্রায় সাড়ে ছয় বছরে তিন দফায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সুবিধাবাদী সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের মোকাবিলায়, সাম্প্রদায়িকতাকে রোখার প্রশ্নে দৃঢ় ভূমিকাত অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায় কঠোর আইন প্রণয়নের প্রশ্নে তাঁদের অঙ্গীকারের ধারপাশ দিয়ে হাঁটেনি। আপসের পথ নিয়েছিল।
ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে মুছে দিয়ে, রাজনৈতিক হিন্দু ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করবার একমাত্র উপায়, ‘মুসলমান মুক্ত’ ভারত। এই কৌশলকে সফল করতে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উদগাতা, আরএসএসের তাত্ত্বিক নির্মাতা এম এস গোলওয়ালকর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকই কেবল নয়, কার্যত নাগরিকত্বহীন করার তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছিলেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন আনে।
তার ভেতর দিয়ে আজকের এনআরসির প্রেক্ষাপট রচনা করা হয়েছিল। তখন বিজেপি’র সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রের সরকারে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস।
এনআরসির দাবি খোদ সংসদের মধ্যে তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের আজকের মুখ্যমন্ত্রী তথা ভারতে প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতার সাম্প্রতিকতম উদগাতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়কাল থেকেই আরএসএস , নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ,অর্থাৎ; বিভাজনের রাজনীতি, হিন্দু মুসলমানকে আলাদা করে রাজনৈতিক ফায়দার যে রাজনীতি ,তাকে ফলপ্রসূ করবার চেষ্টা করেছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই ভারতের স্থিতিশীলতা নষ্ট করবার লক্ষ্যে যে সমস্ত কার্যক্রমের প্রয়োগ ঘটিয়েছিল, সেগুলির অন্যতম হচ্ছে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতা অর্জনের জন্যে, তাদের সহযোগী শক্তি গুলির প্রতিও এক ধরনের সমর্থন জ্ঞাপন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মমতার মত প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগ কারীদের আরও বেশি রকম ভাবে সাহায্য করেছে কমিউনিস্টদের বিনষ্ট করবার লক্ষ্যে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কংগ্রেস দল ত্যাগ করে তাঁর নিজের আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন ,তখন নির্বাচন কমিশনে, সেই দলের স্বীকৃতি, নির্বাচনী প্রতীক পাওয়ার ক্ষেত্রে যিনি সবথেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হলেন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবাণী!
Comments :0