MICROFINANCE WOMEN BENGAL

৫০৫ টাকার জন্য আত্মহত্যা গরিবের ‘ঘরের লক্ষ্মীর’

রাজ্য

শঙ্কর ঘোষাল: বর্ধমান 

  পারুল ঘোষের নাম আছে ভোটার তালিকায়। কিন্তু তিনি ভোট দেবেন না। কারণ—  মাইক্রোফিনান্সের দাপটে গত ২৯ ডিসেম্বর চৈত্রপুরের ওই খেতমজুর মহিলা আত্মহত্যা করেছেন। 
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কথা সবাই জানেন। কারণ মুখ্যমন্ত্রী তার প্রচার করেন। কিন্তু প্রচার, বিজ্ঞাপন না হলেও বর্ধমানের গ্রামাঞ্চলে অতি পরিচিত ‘বউ বন্ধকী ঋণ’। পারুল তারই শিকার। তাঁর স্বামী রাইস মিলের কর্মী। বছর খানেক আগে পারুল ঘোষ একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ২০হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তাঁকে ৫০৫টাকা করে কিস্তি মেটাতে হত। গত ২৮ ডিসেম্বর তাঁর কিস্তি জমার কথা ছিল। কিন্তু তিনি টাকা জোগাড় করতে পারছিলেন না। তিনি ভয় পেয়ে গেছিলেন। কারণ, এই মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলির টাকা আদায় করার লোক থাকে। তাদের বলা হয় ‘বাউন্সার।’ ঋণের টাকা, সুদ না পেলে এই বাউন্সাররা ঋণগ্রহীতাকে বাড়ি এসে যাচ্ছেতাই অপমান করে। মারধর করার অভিযোগও আছে। 
সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে নিজের ওড়নায় গলা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন পারুল ঘোষ।
পারুল ঘোষ একা নন। গত সেপ্টেম্বরে বড়শুলে একই কারণে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তাঁরাও গরিব ছিলেন। হেমন্ত মালিক (৬৫) ও রেখা মালিক (৫৪) ধার করেছিলেন ছোট ছেলের ব্যবসার জন্য। কিন্তু তাঁরা ঋণের কিস্তি  শোধ করতে পারছিলেন না। বাউন্সাররা তাঁদের হুমকি দিয়েছিল বাড়ি বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হবে। প্রথমে এই পরিবার বাউন্সারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলি খোঁজ নিয়ে দামোদর নদীর ওপারে জামদহ গ্রাম থেকে ওই দম্পতিকে টেনে আনে। বাড়িতেই গামছা গলায় জড়িয়ে দু’জন ঝুলে পড়েন। ভোরবেলায় বাড়ির লোক জানালা দিয়ে দেখেন বাবা-মা দু’জনেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছেন।
ঋণে জর্জরিত এই মহিলা কিংবা পরিবারগুলির পাশে তৃণমূলের সরকারকে, সাংসদকে দেখা যায়নি।
আত্মহত্যা আরও কারণ বর্ধমানে ছড়িয়ে। নির্বাচনে সেই প্রতিটির জবাব চাইছেন মানুষ। তবে তাঁদের মতো করে। আর লাগাতার এই সব বিষয়ে প্রতিবাদ করে আসা বামফ্রন্টের প্রচারে মানুষের এই সমস্যাগুলিই প্রাধান্য পাচ্ছে। 
আর কী সমস্যা? 
ক্রমাগত লোকসানে কৃষক চাষবাসে আগ্রহ হারাচ্ছেন। পূর্ব বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রের গ্রামগুলির এটিই ছবি। গ্রামের অর্থনীতি ধুঁকছে। সঙ্কট তাঁতেও। কালনা, পূর্বস্থলিতে প্রায় ৫০ হাজার তাঁতের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাঁত ধুঁকছে। কৃষক ও তাঁত শ্রমিকদের বড় অংশ মহাজনী ঋণে জর্জরিত। খেতমজুরদের অবস্থাও মারাত্মক। একাংশ চাষ, তাঁত ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিক হয়েছেন। ঋণের ফাঁসে জড়িয়ে আত্মঘাতীর পথ বেছে নিয়েছেন অনেকে।
মেমারি-১ ব্লকের ছোট কৃষক হায়দার মল্লিক জানিয়েছেন ‘‘গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার চাষে লোকসানের পর আর বোরো চাষ করছি না।’’ কিন্তু কেন? তাঁর জবাব, ‘‘সহায়ক মূল্যে ধান সরকারকে অধিকাংশ কৃষক বিক্রি করতে পারেনি। মিল মালিকরা কৃষকদের নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে সরকারি ভরতুকির টাকা তুলে নিয়েছে।’’ খণ্ডঘোষের কয়েকটি মিল মালিক ধরাও পড়েছে। সরকার? কোনও পদক্ষেপে নেই। সাংসদ? দেখাই যায়নি তাঁকে। আলুতে চরম ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু সরকারি ক্ষতিপূরণের ঘোষণা আজও হয়নি। আলু চাষের সময় সার কালোবাজারি হয়েছে। চড়া দামে সার কিনে চাষ করতে হয়েছে কৃষককে। যে ইফকো ১০:২৬:২৬ সারের দাম ছিল বস্তা পিছু ১৪০০ টাকা  সেই সার কৃষককে কালোবাজারে কিনতে হয়েছে ২০০০-২২০০ টাকায়। এত দাম দিয়ে সার, কীটনাশক,  বীজ কেনার পর আলু গাছ অকাল বর্ষণে নষ্ট হলো। অনেক জমিতে বিঘে পিছু আলু হয়েছে ২০-৩০ বস্তা। লাভ তো  হয়নি উলটে মহাজনের ধারের টাকা ওঠেনি। সারের কালোবাজারির এই  নৈরাজ্যের ধরন চোখে দেখে তৃণমূলের সাংসদ চোখ বুজে ছিলেন। এইভাবে আলুতে, ধানে লোকসান করার পর  মধ্যবিত্ত কৃষক চাষে আগ্রহ হারিয়ে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। রাস্তায় বিজেপি, তৃণমূল কোনও দলকে নেমে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। কৃষকের পাশে ছিল লাল ঝান্ডা। 
২০১১ সালের পর পূর্ব বর্ধমান জেলায় প্রায় আড়াই হাজার বিঘে জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে বর্গাদার, পাট্টাদারের হাত থেকে। অনেক কৃষকের রায়ত জমিও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তখনও সাংসদ, বিধায়করা জমি লুটেরাদের পাশে ছিল। কৃষকের বহু জমি শাসকের দালাল, নেতারা রাতারাতি পড়চা পরিবর্তন করে জমি কেড়ে নিয়েছে। মেমারির হেতমপুরের কৃষক পরিবার কোহিনুর বিবি তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে আজও প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরছেন জমি ফেরতের আশায়। মুখ্যমন্ত্রী, সাংসদ সুনীল মণ্ডলকে একাধিক চিঠি লিখেও প্রতিকার মেলেনি। মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেছেন সাজানো আন্দোলন!  
সঙ্কটের কথা গ্রামবাসীরা বিস্তারিত জানিয়েন নীরব খাঁকে। তিনিই বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী। মানুষের ক্ষোভ টের পেয়েছে তৃণমূল। তাই সাংসদকে আর প্রার্থী করেনি তারা। কিন্তু প্রার্থী বদলে কী তাঁত, খেতের সমস্যা ভুলিয়ে দেওয়া যাবে? বিজেপিও চেষ্টা করছে, ‘মোদী ফিরলে সমস্যার সমাধান হবে’ বোঝাতে। কৃষক বিপুল রায়ের কথা,‘‘মোদীই তো বলেছিলেন কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে। কী হয়েছে? হয়নি। তাহলে?’’

Comments :0

Login to leave a comment