‘‘ওবিসিদের নাম কাটো, নাহলে তোমার চাকরিই কেড়ে নেব। এইভাবেই ছেলেকে হুমকি দিচ্ছিলেন এসডিএম এবং বিডিও।’’ উত্তর প্রদেশের গোণ্ডায় আত্মঘাতী বিএলও শিক্ষক বিপিন যাদবের বাবা সুরেশ যাদব বুধবার কাঁদতে কাঁদতে এ কথা বলেছেন। বুধবার তাঁর এই বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে উত্তর প্রদেশের এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব এদিন সরাসরি অভিযোগ করে বলেছেন, বিজেপি এবং নির্বাচন কমিশন মিলে উত্তর প্রদেশে ৩ কোটি ভোটারের নাম কাটতে চাইছে। সমাজবাদী পার্টি ছাড়াও কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলি এই নিয়ে সরব হয়েছে। এরমধ্যেই বুধবার বরেলিতে এসআইআর-র কাজ করার সময়ে বিএলও সর্বেশ কুমার গাঙ্গওয়ারের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে চার জন বিএলও-র মৃত্যু হলো। তাঁদের মধ্যে দুই জন আত্মঘাতী হয়েছেন।
রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কাজে অবহেলার নামে বিএলও-দের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। শুধু এলাহাবাদেই ৪০ জন বিএলও-র বেতন আটকে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, এরপরেও যদি কাজে অবহেলা করা হয়, তাহলে তাদের চাকরিই খারিজ করে দেওয়া হবে। নয়ডা যা এখন গৌতম বুদ্ধ নগর জেলা সেখানে ৬০ জনের বেশি বিএলও এবং অন্য কর্মীদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। বিএলও ছাড়াও এদের মধ্যে রয়েছেন সহায়ক এবং সুপারভাইজার। ৬ জন সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। বাহারাইচ, বরেলি সহ অন্য জেলা থেকেও বিএলও সহ এসআরআর-র কাজে যুক্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার খবর সামনে এসেছে। এসআইআর-র কাজে গিয়ে এইরকম ভয়ঙ্কর চাপ এবং হুমকির মুখে পড়ে একজন শিক্ষিকা আগেই ইস্তফা দিয়েছিলেন নয়ডায়। বুধবার আরেকজন শিক্ষামিত্র মহিলাও ইস্তফা দিয়েছেন। ইস্তফা পত্রে তিনি লিখেছেন, ২০ বছর ধরে পড়াচ্ছি। কিন্তু এখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বিএলও বানিয়ে এসআইআর-র যে কাজ দেওয়া হয়েছে, তাতে ভয়ঙ্কর মানসিক চাপের মধ্যে আছি। আধিকারিকরা শিক্ষকদের বিএলও বানিয়ে জবরদস্তি ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করছে।
এই সবের মধ্যে বুধবার নিহত বিপিন যাদবের বাবার অভিযোগ সামনে আসার পরে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে। তিনি সংবাদ মাধ্যমের সামনে সরাসরি অভিযোগ করেছেন, ‘‘আমার ছেলে মৃত্যুর আগের দিন রাতে ফোন করেছিল। ফোনে সে আমাকে বলে, ওবিসিদের নাম বাদ দেওয়া এবং সাধারণ অংশের নাম ঢোকানোর জন্য এসডিএম এবং বিডিও আমাকে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। এই কাজ করতে রাজি না হওয়ায় আমাকে সাসপেন্ড এবং গ্রেপ্তার করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’’ সুরেশ যাদব এদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘ছেলেটা ফোনে কাঁদছিল। আমি বুঝিয়ে বলেছিলাম, হতাশ হও না। সকালে দশটায় খবর পেলাম ছেলে বিষ খেয়ে নিয়েছে।’’ উল্লেখ্য, বিপিন যাদব এসআইআর-র কাজ করছিলেন। মঙ্গলবার সকালে তিনি বিষ পান করেন। প্রথমে তাঁকে গোণ্ডা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপর অবস্থা খারাপ হলে লক্ষ্ণৌয়ের কেজিএনইউ-য়ে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। বিপিন যাদব জৌনপুরের মলহানি গ্রামের বাসিন্দা। মৃত বিএলও-র স্ত্রী সীমা যাদব বলেছেন, এসডিএম, বিডিও এবং লেখপাত গত ২-৩ মাস ধরে তাঁর স্বামীকে হুমকি দিচ্ছিলেন। যাদের নথিপত্র নেই, তেমন লোকদের নামও জোর করে তালিকায় ঢোকানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। কয়েকশো লোকের তালিকা বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের নাম তালিকায় ঢোকানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। তিনি অভিযোগ করেছেন, এই সব অফিসাররা মিলে আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছেন। নিহত বিপিনের শ্যালক শচীন যাদব বলেন, আমার প্রতিদিন ফোন কথা হতো জামাইবাবুর সঙ্গে। তিনিও অভিযোগ করেছেন, ওবিসিদের নাম বাদ দিতে এবং উঁচু জাতের লোকদের নাম যুক্ত করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। যথারীতি এসডিও এবং অন্য আধিকারিকরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জেলাশাসক ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতা অজয় রায় সরাসরি জেলাশাসকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ এনেছেন। তিনি এদিন বিপিন যাদবের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। অজয় রায় বলেন, জেলাশাসক নিজেই এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এসডিএম, বিডিও এবং লেখপালের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করার দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গোণ্ডা হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়েই বিপিনের স্ত্রী তাঁর স্বামীর বক্তব্য ভিডিও করে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেন। সেই ভিডিও-তে বিপিন যাদব নবাবগঞ্জের এসডিএম বিশ্বামিত্র সিং, নবাবগঞ্জের বিডিও রবি গুপ্তা এবং লেখপালের বিরুদ্ধে হুমকি এবং চাপ দেওয়ার অভিযোগ করেন। কোনোরকম তদন্তের আগেই জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা নিরঞ্জন জানিয়ে দেন, পারিবারিক অশান্তির জেরেই ওই বিএলও আত্মঘাতী হয়েছেন।
এদিকে ফতেপুরে অ্যাকাউন্টট্যান্ট সুধীর কুমার কোরি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন। তিনি বিএলও-র কাজ করছিলেন। বুধবার সুধীরের বিয়ে ছিল। সেই জন্য আগে থেকেই বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। সোমবার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সুধীর এসআইআরের কাজে যাননি। এরপরেই তাঁর ঊর্ধ্বতন এক রাজস্ব অফিসার মঙ্গলবার সকালে বাড়িতে এসে সুধীর কোরিকে অশ্রাব্য গালাগালাজ করে এবং নানাধরনের হুমকি দেয়। এর জেরেই সুধীর নিজের ঘরে ঢুকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়েন। বিয়ের এক দিন আগে এমন ঘটনায় এলাকার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁর সহকর্মীরাও বাড়িতে চলে আসেন। পাশাপাশি হিসেব রক্ষকদের সংগঠনও প্রতিবাদে সুধীরের বাড়ির সামনে অবস্থান শুরু করে। সুধীরের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর হবু স্ত্রী ও পরিবারের অন্য লোকেরা ছুটে আসেন। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে জানান, ছুটি দেওয়া নিয়ে অশান্তি করছিলেন আধিকারিকরা। তাঁর চাকরি খেয়ে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল। অভিযুক্ত আধিকারিকের বিরুদ্ধে এফআইআর-র দাবিতে সুধীর কোরির দেহ আটকে বসে থাকেন পরিজন এবং সহকর্মীরা। শেষ পর্যন্ত বুধবার অভিযুক্ত আধিকারিকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হওয়ায় ৩০ ঘণ্টা পরে দেহ শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
এই সব ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি। দলের নেতা অখিলেশ যাদব আগেই দেড় লক্ষাধিক বিএলও-কে খোলা চিঠি লিখে এই অমানবিক পরিস্থিতি এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সরব হওয়ার আবেদন করেছিলেন। এদিন অখিলেশ সরাসরি অভিযোগ করে বলেছেন, রাজ্যের ৩ কোটি ভোটারের নাম কাটতে চাইছে বিজেপি-নির্বাচন কমিশন। তিনি বলেন, আগে একজন কোরি এবং পরে একজন যাদব বিএলও এদের হুমকির জন্য আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার বিজেপি কাড়তে চাইছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, বিহারে এই কাজ করা হয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর প্রদেশেও বিজেপি একই কাজ করতে চাইছে। তিনি এসআইআর-র কাজে যুক্তদের মৃত্যুর ঘটনায় ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছেন। তাঁর দলের পক্ষ থেকে এইরকম যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন।
Comments :0