CPI(M) 27TH STATE CONFERENCE

‘রাজ্যে পরিবর্তন সম্ভব, যে পার্টিকে মানুষ সন্মান করে, সেই পার্টি গড়তে হবে’

রাজ্য

‘‘রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। মানুষই সেই পরিবর্তন আনবেন। মানুষ চাইছেন আমরা মানুষের যোগ্য হয়ে মানুষের কাছে যাই। আমাদের তার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। রাজ্য কী পথে চলছে মানুষ দেখছেন। গরিবের মধ্যে নানা ঘাত প্রতিঘাত চলছে। মন্ত্রী জেলে। কিন্তু সরকার কী করছে? তাদের সঙ্গে আমাদের ভূমিকা মানুষ মিলিয়ে নিচ্ছেন। এরই মধ্যে এসে পড়েছে গেরুয়া বাহিনী। বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে, তাদের বাধা ভাঙতে নেমেছে আরএসএস। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।’’ 
সেদিন সিপিআই(এম)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৪ তম সম্মেলনে এই আহ্বান জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তার আগের দিন, ১১ মার্চ, বুধবার সম্মেলনে ‘বামফ্রন্ট সরকার: একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক খসড়াটি পেশ করেছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য সূর্য মিশ্র। সম্মেলনে ২৭জন প্রতিনিধি ওই খসড়া নিয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া সম্মেলনে ৭৬টি লিখিত সংযোজন, সংশোধনী জমা পড়েছিল। গত ২৪  ফেব্রুয়ারি ওই খসড়াটি ফেসবুকে, পার্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিল পার্টি। উদ্দেশ্য ছিল সমাজের নানা অংশের মানুষের মতামত, প্রস্তাব, সংশোধনী, সমালোচনা। মাত্র আঠারো দিনে দশ হাজার জন ওই খসড়াটি দেখেছেন, পড়েছেন। অনেকেই মতামত দিয়েছিলেন। সেই সব মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এদিন জবাবী বক্তব্য পেশ করেন পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। 
তিনি গোড়াতেই বলেন যে, ‘‘অনেক পরামর্শই গ্রহণযোগ্য। এই বিষয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিট ব্যুরোতে আগে আলোচনা হয়েছিল। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিট ব্যুরো জানিয়েছিল যে, এই বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। দলিল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা তাই খসড়াটি তৈরি করেছি।’’ 
কেন এই দলিল তৈরির উদ্যোগ? এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন,‘‘৩৪ বছর সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ দরকার ছিল। শুধু জয়যাত্রার ইতিহাস লেখার জন্য নয়। পরাজয়ের দলিলও নয়। এই দলিলের গুরুত্ব রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য, রাজ্যের বাইরের জন্য, এমনকি বিদেশেও এই দলিলের গুরুত্ব আছে। আমরা চাই এটি একটি আন্তর্জাতিক সম্পদ হোক। মানুষ জানতে চান আমাদের অভিজ্ঞতা কী? অনেকেই আসেন, বিদেশ থেকেও আসেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পরে নানা ঘটনা ঘটেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি অঙ্গরাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনার মধ্যে দিয়ে মার্কসবাদের পরীক্ষা, প্রয়োগ কী হলো—  তা দেখা, বিচার করা জরুরি। পাশপাশি আমাদের পার্টি কর্মসূচির দেখানো পথের সঙ্গে এই ৩৪ বছরের সরকারের সম্পর্কগুলিও খতিয়ে দেখা দরকার। তার জন্য এই দলিল। অতীতকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে আমরা এগতে পারবো না। এই দলিলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন লেখা, পক্ষে বিপক্ষে যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের কথাও গুরুত্ব দিয়েছি।’’
সেদিন ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার এই দলিলের চারটি মূল স্তম্ভ—  কৃষির অগ্রগতি, মানবোন্নয়ন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা। ৩৪ বছর রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ দেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নতুন অর্থনীতি অর্থাৎ উদারনীতি যখন শুরু হলো, তখন সমাজে তার প্রভাব কী হলো? এই অর্থনীতি অনেক প্রান্তিক মানুষ তৈরি করল। যারা অসহায়। বামফ্রন্ট সরকার তাঁদের রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করেছে, ২টাকা কেজি চাল দেওয়ার কাজ শুরু করেছে, সাইকেল দিয়েছে। ছাত্রীদের বিনা পয়সায় পোশাক, একগুচ্ছ ভাতার বন্দোবস্ত বামফ্রন্ট করেছে। আরও অনেক কাজই আমরা করেছি। গরিব, প্রান্তিক মানুষকে রক্ষা করতে বামফ্রন্ট সরকার চেষ্টা করেছে। দলিলে তথ্য দেওয়া হয়েছে বেশকিছু। তথ্য থেকেই তত্ত্বে পৌঁছানো যায়। যেমন রাজ্যে ৩৪ বছরে ভূমিসংস্কার। ৩০ লক্ষ কৃষক পাট্টা পেলেন ১১ লক্ষ ২৭ হাজার একর জমির। এর তাৎপর্য কী? সারা দেশে এমন আর কোথায় হয়েছে? গরিবের ক্ষমতায়ন এনেছে ভূমিসংস্কার। এই সাফল্য শুধু কৃষক আন্দোলন কিংবা কৃষকের জমির অধিকার পাওয়া, ক্ষমতায়নও নয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে ভূমিসংস্কার—  এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই কাজ না হলে শিল্পের চাহিদা জন্মাতো না। শিক্ষা ক্ষেত্রেও আমরা জোর দিয়েছিলাম। গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি। সবচেয়ে বড় কাজ প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব। শিক্ষার আঙিনায় ৯৯ শতাংশকে আনতে পেরেছি। কিন্তু অনেকে এই সমালোচনা করেছেন আদিবাসী সহ তথাকথিত নিম্নবর্গীয় ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছিলো তো?’’
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘‘তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের পর থেকে আমাদের কাছে কিছু বিষয় স্পষ্ট হচ্ছিল। গরিবের মধ্যে বিভাজন তৈরি হচ্ছিল। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত হচ্ছিল কোথাও কোথাও। যে পঞ্চায়েত, পৌরসভা তৈরি করেছি সেখানে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পরিচালনা করতে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির বদলে পার্টি পরিচয়ের দৃষ্টিভঙ্গি এসে যাচ্ছিল কোথাও কোথাও। পার্টির পরিসর, পরিবার গুরুত্ব পাচ্ছিল। তারপর তা আমার পরিবার পর্যন্ত বাড়তে লাগলো। আমরা পুরোপুরি ঠেকাতে পারিনি। ২০০৮-এ পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা অশনি সঙ্কেত পেলাম। কিন্তু তার তাৎপর্য আমরা সম্যক বুঝতে পারিনি। শুরুর সময়েই আমাদের নেতারা সতর্ক করেছিলেন পঞ্চায়েত এক ধারালো অস্ত্র, ব্যবহার ঠিক মতো করতে না পারলে নিজের হাতই কাটবে, আটকাতে পারবে না। বামফ্রন্টের শিক্ষানীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ভালো হয়নি। ঠিক ছিলাম না। কী লাভ হলো? ক্ষতিই তো বেশি হলো। মানুষ পছন্দ করেননি। ইংরেজি শিক্ষা সংক্রান্ত আমাদের নীতিকে পর্যালোচনা করলাম না। দেখলাম এক সময়ের পরে সরকারি স্কুল ছেড়ে মানুষ পাশের বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছে। ব্যাখ্যা করলাম না বিষয়টিকে। শিল্পায়ন প্রসঙ্গে ভট্টাচার্য বলেন, এই বিষয়ে প্রথম বামফ্রন্টের দলিল আছে। ১৯৯০-৯১ থেকে দ্রুত অবস্থা বদলাতে লাগলো। ১৯৯২-৯৩-এ দেশে নতুন নীতি এসে পড়ল। তার আগে আমাদের ক্ষুদ্রশিল্পে সাফল্য এসে গেছে। সেই সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শিল্প দরকার। তখন কমরেড জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী। আমাদের বোঝান যে, এই অবস্থার সুযোগ নিতে হবে। নয়া আর্থিক নীতির ফলে সব রাজ্যে বিনিয়োগ আসবে, আর বাংলা পাবে না? তাই বিদেশি বিনিয়োগে আমরা না বলিনি। তবে পারস্পরিক স্বার্থে আমরা বিনিয়োগ চেয়েছি। তারা তো শোষণ করবে। মুনাফা করবে। কিন্তু আমরা চাই রাজ্যের যুবক যুবতীদের কাজের সুযোগ। আমরা ইস্পাত, অটোমোবাইলস, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিলাম। ২০১০-এ সর্বোচ্চ ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এল। তারই মধ্যে বিশ্ব এবং দেশের অর্থনীতিতে সঙ্কট চলে এল। পুঁজিবাদ সেই সঙ্কট থেকে বেরোতে পারে না। সেই সঙ্কট এখনও চলছে।’’
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন,‘‘আগামী দিনে কী হবে? রাজ্য কোন পথে এগবে? বামপন্থীদের, সিপিআই(এম)’র দায়িত্ব, ভূমিকা কী হবে? পঞ্চায়েত কিছু আছে। পৌরসভা নির্বাচন সামনে। আমাদের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমরা কী চাই, বলতে হবে। রাজ্যে এখন আমরা বিরোধী দল। বিরোধী দল হিসাবে আমাদের ভূমিকা কী হবে? কোন লক্ষ্যে আমরা এগবো? এইসবই ঠিক করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে, প্রথমত, কৃষির সাফল্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, পঞ্চায়েতকে কলুষমুক্ত করতেই হবে আমাদের। মানুষের মন ভেঙে যাচ্ছে। আমরা করবোই কলুষমুক্ত। মানুষের যে অংশ আমাদের ছেড়ে গেছে, তাঁদের আমাদের সমর্থনে, পক্ষে ফিরিয়ে আনতেই হবে আমাদের।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মানুষ নতুন ধরনের পার্টি দেখতে চায়। বিভিন্নভাবে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকার কিছু নেতার কার্যকলাপ মানুষকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশে একদলীয় দাপাদাপি চলতে পারে না। বহুত্ববাদ মানতেই হবে। আমাদের কিছু কর্মী মানুষের পছন্দ নয়। এই ধরনের কর্মীরা আর আমাদের পার্টিতে থাকবেন না ভবিষ্যতে। যে পার্টিকে মানুষ সন্মান করে, আস্থা রাখে সেই উজ্জ্বল ভাবমূর্তির পার্টিকেই আমরা গড়তে চাই। মানুষ তাই দেখতে চান।’’ পার্টি এবং সরকারের মধ্যে সম্পর্ক, সামঞ্জস্য সম্পর্কে ভট্টাচার্য বলেন,‘‘অনেকে এই প্রশ্ন করেন। জমি বণ্টন না হলে কী কৃষক আন্দোলন এই মাত্রা পেত? আবার কৃষক আন্দোলন সরকারকে এগতে সাহায্য করেছে। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা বিভিন্ন আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছে। মনে রাখতে হবে দুটো আলাদা মাঠে খেলার মতো নয় সরকার আর পার্টির সম্পর্ক। একই মাঠে সবাই দায়িত্ব নিয়ে খেলছে। এক অংশ আরেক অংশ সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকতে পারে না।’’ তিনি বলেন, সম্মেলন থেকে আমাদের ডাক কী? আমরা বলছি ঘুরে দাঁড়াও, বিচ্ছিন্নতা কাটাও। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করো। রাজ্যে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তার পরিবর্তন দরকার। তা সম্ভব। কিন্তু চাইলেই দরজা খুলবে না। মানুষই সেই দরজা খুলবেন। পার্টির কর্মী হিসাবে আমাদের মৌলিক কাজ করে যেতে হবে ধারাবাহিকভাবে। অর্থসংগ্রহ করতে হবে, পার্টি পত্রিকা পৌঁছে দিতে হবে। প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে যেতে হবে।’’

Comments :0

Login to leave a comment