TEA GARDEN CULTURE THEATRE

ধুঁকছে চা বাগানে সংস্কৃতি চর্চা, আছে সম্ভাবনাও

জেলা

ছবি: প্রবীর দাশগুপ্ত

তমোজিৎ রায় 

গোড়ার কথা 

দার্জিলিং বাদ দিয়ে প্রায় তিনশোর কিছু বেশি বাগান রয়েছে তরাই- ডুয়ার্স অঞ্চলে। মূলত জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে কিছুটা আর হালে গড়ে ওঠা নতুন জেলা আলিপুরদুয়ারে। চাবাগানের বাঙালি করণিক শ্রেণি মানে বাগানিয়া বাবুদের অবসর যাপনের মাধ্যম হিসেবেই গড়ে উঠেছিল তরাই ডুয়ার্সের চা বলয়ের নাট্য উদ্যোগ । বিনোদনই প্রধান উদ্দেশ্য যদিও, তবুও অনেকেই বেশ ধারাবাহিক ভাবেই করেছিলেন থিয়েটারের কাজ। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে ডুয়ার্সের নাট্যচর্চা তার শতবর্ষ অতিক্রম করেছে ২০১৬’তে। 

পশ্চিম ডুয়ার্সের গঞ্জ শহর ওদলাবাড়িতে শুরু হয়েছিল মেবার পতননাটকের মহড়া  ম্যারাপ বেঁধে ১৯১৬’র মাঝামাঝি, সে যুগের স্বদেশিয়ানা কে হাতিয়ার করে। বাগান বাবুরা ও পূর্ব বঙ্গীয় শিক্ষিত বাঙালী কাষ্ঠ ব্যবসায়ী, এঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহমান হয়েছে এই অনুন্নত, ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত ডুয়ার্সের নাট্য ধারা।  মূলতঃ  তাঁদের অর্থানুকুল্যেই বানারহাট মালবাজার , ডামডিম, চালসা, গয়েরকাটা,মেটেলি , ওদলাবাড়ি সহ অনেক বাগানে , বা বাগান-শহরে গড়ে উঠেছিল অনেক কাঠের তৈরি  আধুনিক মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ। কখনো মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে শ্রমিক মহল্লায় ও ছড়িয়ে পড়েছিল এর উন্মাদনা। 

উজ্জ্বল ব্যতিক্রম স্বরূপ দু-একটি বাগানে শুধু বিনোদন নয়, শ্রমিকরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও বেছে নিয়েছিলেন থিয়েটারকে । বিন্নাগুড়ি চা বাগানে চা শ্রমিক দের মধ্যে সচেতনতা বিস্তারের জন্য সিআইটিইউ’র উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ওয়ার্কার্স থিয়েটার। সুরঙ্গ মে আগ’  নাটক টি তৈরি করে নানা বাগানে করে বেড়ান তাঁরা। এই নাটকে মিশে গিয়েছিল, হিন্দি , নেপালি, মদেশিয়া সংলাপ , যা সব   অর্থেই বৈপ্লবিক। টানা চার বছর ধরে এই নাটক চলেছিল । ৮০’র দশকের মধ্যভাগে কালচিনিতে গড়ে উঠেছিল একটি ব্যতিক্রমী ক্লাব-মজদুর মৈত্রী সঙ্ঘ। বাগানের ক্লাব  বলতে আমরা সাধারণত বাঙালি বাগান বাবুদের ক্লাবই দেখে থাকি বা দেখে এসেছি। কিন্তু কালচিনিতে সম্ভবত প্রথম ও একমাত্র শ্রমিক শ্রেণির সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে উঠেছিল যারা লোকগান , লোকনৃত্যের পাশাপাশি নাটকও করেছেন মূলত নেপালী ভাষায়। 

বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী মানগোলেই ছিলেন এই কর্মযজ্ঞের মুল হোতা।তাঁর যোগ্য সঙ্গী ছিলেন বিমল বাহাদুর গুরুং। নিজেদের নাটকের পাশাপাশি তাঁরা আয়োজন করতেন নেপালি নাটকের উৎসব ও প্রতিযোগিতা।  এই যে ছিল’, ‘করতেনবলছি , এর কারণ খুব কম বাগানেই এখনও টিকে আছে নাট্য তথা সংস্কৃতি চর্চা, তা-ও টিমটিম করে। শ্রমিক মহল্লায় ও তেমন করে বেজে ওঠে না মাদলের দ্রিমি দ্রিমি। পরবে এখন ডিজে বাজে। একদা বিখ্যাত মঞ্চগুলোর বেশিরভাগটাই আজ আর ব্যবহারের উপযোগী নয়। কেন? এই উত্তরগুলো আমরা খুঁজবার চেষ্টা করব আগামী কয়েকটি অনুচ্ছেদে। 

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত 

২০০০ সাল থেকেই প্রায় উত্তরবঙ্গের সর্বত্র একের পর এক চা বাগান বন্ধ হচ্ছে , রুগ্ন হচ্ছে , বা হস্তান্তর হয়ে  চলেছে । কখনও খুললেও চলছে ধুঁকে ধুঁকে। ডানকান, গুড্রিক এর মতো বড় চা নির্মাতাদের উর্ধ্বমুখী মুনাফা সত্ত্বেও উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার  ও বৃদ্ধি করার জন্য এবং শ্রমিক কল্যাণের জন্য পুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার অনীহা ফড়ে , ব্যাপারী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যাওয়া অধিকাংশ বাগানে শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি পিএফ ইত্যাদির ক্ষেত্রে সীমাহীন বঞ্চনা, দায়হীন নির্বাধ লুঠ, বাগান থেকে মুনাফা তুলে ফাটকাবাজি ইত্যাদি নানা কারণ এর জন্য দায়ী (groundxero.in,2018 ) । 

অনেক বন্ধ বাগানে শ্রমিকরা স্বনির্ভর গোষ্ঠী খুলে পাতা তুলে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন । চলছে আন্দোলন ও ত্রিপাক্ষিক বৈঠকও।  তবু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই  শ্রমিকদের দুর্দশা অন্তহীন। উৎপাদনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যতদিন চালু থাকে বা স্বাভাবিক নিয়মে পাতা আসে , বাগান চালু থাকে ততদিন।  বাকি সময় প্রচুর শ্রমিক চলে যান জন খাটতে , ভিন রাজ্যে। শ্রমিকদের আবাস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বাচ্চাদের পুষ্টি, শিক্ষা সবই অতলান্তিক অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই অন্ধকারকে গাঢ়তর করে তুলেছে নারীপাচার এর পাপ (FII2018) । 

শ্রমিকদের সীমাহীন দুর্দশার সুযোগ নিয়ে নানা আড়কাঠিদের মদতে উত্তরের এই বাগান গুলো হয়ে পড়েছে মানুষ বিক্রিরবড় বাজার। তাঁদের সংস্কৃতি অবশ্যই প্রগতি বিমুখ হবে।  তাছাড়া বাগানবাবু শ্রেণি, যারা বাগান নাটকের চালিকা শক্তি ছিলেন তারা বেশির ভাগই বাগান ছেড়ে খুঁজে নিয়েছেন অন্য চাকরি বা অনেকেই থাকছেন পাশের কোন শহরাঞ্চলে। সেখানে নিয়েছেন বাগানের চাকরির পাশাপাশি অন্য কোন জীবিকা। স্বভাবতঃই সংস্কৃতি চর্চার পথ যে রুদ্ধ হয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য । 

  রাজনৈতিক বাতাবরণ 

২০১১ তে বাংলায় রাজনৈতিক পালা বদল হয়। চা বলয়ের রাশ ও বামেদের হাত থেকে আলগা হয়ে যেতে থাকে ক্রমশঃ। বাম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে গ্রাস করে নিতে থাকে পরিচয়ের রাজনীতি। ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসে স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নানা জনমুখী প্রকল্পের মুখোশের আড়ালে তাদের নিজস্ব একমেবাদ্বিতীয়ম হিন্দুত্বের এজেন্ডা নিয়ে। আদিবাসীর নিজস্ব ধর্মাচরণ নিজস্ব সংস্কৃতি যেন একটু একটু করে ঢাকা পড়ে যায় গৈরিক মেঘের আড়ালে। করমপুজার প্রাণবন্ততাকে যেন চাপা দিয়ে দেয় হনুমান জয়ন্তী, রামনবমীর জৌলুশ। 

ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানের জন ওরাওঁ (জলপাইগুড়ি জেলা কোর্টের করণিক, চা শ্রমিকের সন্তান) এবং কবিতা ওরাওঁয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। জন ধর্মে খ্রীস্টান ও কবিতা সারি ধর্ম পালন করেন। তাঁদের সন্তান  চার বছরের সুরজকে এখনও কোন ধর্মের দীক্ষা দেননি। এ যাবত তাঁদের জীবন ধারনে কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বিগত দু-এক বছরহনুমান জয়ন্তীতে অংশ নেওয়া , রাম নবমীর মিছিলে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে নানা রকম চাপের সম্মুখীন তারা হচ্ছেন। এক বিরাট হনুমান মন্দির তৈরি হয়েছে সেখানে, প্রতিদিন ঘটা করে পাঠ হয় হনুমান চলিশা , রীতিমতো মাইক্রোফোনে।  সন্ধ্যায় সেখানে যাওয়া প্রায় অভ্যাস করে ফেলেছেন বাগানের আদিবাসী সমাজ। বন্ধ হয়ে গেছে , ওয়ার্কার্স রিক্রিয়েশন ক্লাবের বাচ্চাদের কবিতা ও গান শেখার ক্লাস। পাঠাগারটির বই খেয়ে ফেলছে পোকা। এ শুধু ডেঙ্গুয়াঝারের ছবি নয়। সমগ্র বাগান অঞ্চলেই এই অবক্ষয় বড় প্রকট । 

সামাজিক-সাংস্কৃতিক   

নব্বই এর দশকের পর থেকেই বিশ্বায়নের হাওয়া একটু একটু করে এলোমেলো করে দিয়েছে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে।  একটু দেরিতে হলেও উত্তরবঙ্গও সেই হাওয়ায় নিজের সংস্কৃতির শুদ্ধতা কে ধরে রাখতে পারছে না। তাই ভাওয়াইয়াতে বাজে এখন সিন্থেসাইজার। মেচেনি নাচের ছন্দে দেখা যায় বলিউডি ঠমক। চা বলয়ে এই বাজারি সংস্কৃতির বিষ বাষ্প মূলত ঘিরে ফেলেছে তরুণ প্রজন্মকে। মোবাইল অবশ্যই সবচেয়ে বড় অনুঘটক। মোবাইলে বুঁদ তরুণ প্রজন্ম টিকটক ও ইউটিউবকেই করে নিয়েছে তাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। তাছাড়া অভাব কর্মসংস্থানের, অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে স্কুল ছুটের সংখ্যা। বেশির ভাগ তরুণই কাজের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছে শহরে বা ভিন রাজ্যে। পড়ে রয়েছে যারা তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর ভাবে দেখা দিচ্ছে নেশায় আসক্তি। নেশার তাড়নায় জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ মূলক কাজে। 

বন্ধ কালচিনি বাগানের প্রৌঢ়া ফুলমণি কুজুর জানিয়েছেন তাঁর ক্লাস এইটের নাতিকে নেশা মুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি করতে হয়েছে। তিনি কাজি মানগোলের নাচের দলে নিয়মিত নাচতেন। তাঁর স্মৃতিতে এখনও ধরা রয়েছে কালচিনি বাগানের উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক পরিবেশ। কী ভাবে পালটে গেল এই পরিবেশ, তিনি তার জীবন্ত সাক্ষী। এখন বন্ধ বাগানে তাঁরা অস্তিত্বের লড়াই করছেন, এ লড়াইয়ে সংস্কৃতি তাঁদের পাশে নেই। 

শেষ কথা 

উত্তরের চা বলয়ের ভেঙে পড়া আর্থসামাজিক পরিকাঠামো,পরিবর্তিত রাজনৈতিক বিন্যাস ও সেই সাথে বাজারি সাংস্কৃতিক দাপট  তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নাট্য চর্চার উজ্জ্বল ইতিহাস আজ উত্তরাধিকার শূন্য। নেশাসক্তি , উচ্ছৃঙ্খলতা, অপুষ্টি , অশিক্ষা তাঁদের ঘটমান বর্তমান। এই বর্তমান, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার পরিপন্থী এবং সুস্থ সংস্কৃতির অভাবেই তৈরি হয়েছে বাগানের তরুণ প্রজন্মের এই জীবন চর্যা যেন এক দুষ্ট চক্র। 

যদিও অন্ধকারময় এই সময়ে কিছু রুপোলি রেখা আমরা দেখেছি মালবাজার , ডামডিম, ডেঙ্গুয়াঝার , গয়েরকাটা, চালসায়। সেখানে এখনও কিছু মানুষ নাট্য চর্চা বজায় রেখেছেন মনের তাড়নায়। ডামডিমে শ্রমিক পরিবারের কচিকাঁচারা শিখছে নাটক আবৃত্তি ছবি। ডেঙ্গুয়াঝারে একদল আদিবাসী ছেলে গড়েছে গানের দল। তাঁরা ওঁরাও গান করে এবং নানা জায়গায় অনুষ্ঠান করে রোজগারও করে। কিছু বাগানে আছে পেশাদার আদিবাসী নাচের দল যারা নানা সরকারি বেসরকারি উৎসবে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। তবে এই ধরনের ফরমায়েশি নৃত্য চর্চায় প্রাণের আরাম বা মাটির গন্ধ কমই থাকে। সামগ্রিক ভাবে বাগান অঞ্চলের সংস্কৃতির ছবিটা বেদনার । অর্থনীতির উন্নয়নের সাথে সাথে হয়ত ছবিটা পালটাবে। সেই সঙ্গে মধ্যবিত্ত বাঙালী শ্রেণি যারা বাগানের সংস্কৃতি চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ছিলেন এক সময়, তাঁরা যদি আবার এগিয়ে আসেন, আদিবাসী তরুণ প্রজন্মকে দিতে পারেন উপযুক্ত পথ নির্দেশ বা নিজস্ব শিকড়ের সন্ধান তাহলে হয়ত আপাত রুদ্ধ চাকাটা আবার ঘুরতে পারে।   

   যাঁদের সাহায্য ছাড়া সম্ভব হতো না এ লেখা

       জন ওঁরাও ( ডেঙ্গুয়াঝাড় )

      দীলিপ ঘোষ    (বানারহাট)

      ব্রজদুলাল বসু        (গয়েরকাটা)

      কানাই চট্টোপাধ্যায় (ঐ )

      সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়( কালচিনি)

      ফুলমনি কুজুর ( কালচিনি )

তথ্যসূত্র:

      ‘ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিন্নাগুড়ি । ভরত চন্দ্র বড়ুয়া। ২০০৭(কাশফুল। ৭২ তম সার্বজনীন দুর্গাপূজা , বিন্নাগুড়ি) 

      Groundxero.in (2018 ): চা বাগান ও চা শিল্পের তথাকথিত রুগ্নতা ও শ্রমিক আন্দোলন প্রসঙ্গে . সৌমিত্র ঘোষ , (অগাস্ট ১০,২০১৮ )

      Feminism in India (2018): Tea Gardens of North Bengal : A hotbed of Human Trafficking . Alankita Anand. August1, 2018 .

 

Comments :0

Login to leave a comment