Post Editorial INSAF JATRA

ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিতেই ইনসাফ যাত্রা

রাজ্য

ধ্রুবজ্যোতি সাহা


কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আমরা। বিশ্বে আগ্রাসী শক্তির আস্ফালন, হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যাচ্ছে প্যালেস্তাইনে। নিজেদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন তাঁরা। শান্তির ডাকে সাড়া নেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। এই সংঘাত তাদের নতুন মুনাফা তোলার হাতিয়ার হিসাবে দেখছে তারা। দুনিয়াজুড়েই অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির রমরমা, তাকে আরও তীব্র করতে চাইছে। কিন্তু প্রতিরোধের বার্তাও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। এই প্রতিরোধের সারিতে কি থাকবে না বাংলা? 
এই প্রশ্ন নিয়ে, বিশেষ করে যুবজীবনের জ্বলন্ত প্রশ্ন নিয়ে রাস্তাতেই থাকতে চাইছি আমরা। এই সময়ে নয়া উদারবাদী আগ্রাসনের ফলে যুব জীবনের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে সীমাহীন বেকারত্ব। স্বাধীনতার পরবর্তীতে এই সময় সর্বোচ্চ বেকারত্ব আমাদের দেশে। স্থায়ী কাজের ধারণা দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে অস্থায়ী কাজের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ছদ্ম বেকারত্ব বাড়ছে, শহরে এবং গ্রামে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্বের হার। কেন্দ্রীয় সরকার একদিকে কর্মসংস্থানের নামে দেশের যুবসমাজকে প্রতারণা ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েই চলেছে অন্যদিকে রাজ্যের সরকার কর্মসংস্থানের দিকে মনোনিবেশ করার বদলে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের চাকরিকে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করছে, চাকরিপ্রার্থীদের রাস্তায় বসতে বাধ্য করছে। 
এরাজ্যের অসংখ্য যুবক আজ যে কোনও একটি কাজের সন্ধানে ভিনরাজ্যে। কফিন বন্দি হয়ে কত পরিযায়ী শ্রমিকের দেহ আসছে! কে রাখে তাদের খবর? কফিন বন্দি হয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের লাশ আসছে না, আসছে আমার বাংলার মা-বাবাদের স্বপ্নের ভাঙাচোরা রাজপ্রাসাদের টুকরোগুলো, আসছে যুবদের তিল তিল করে ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার স্বপ্নের সিঁড়িগুলি। ওরা শুধু আমাদের কাজ চুরি করেনি, ওরা বেকার ছেলেদের স্বপ্ন চুরি করে নিয়েছে।
বীরভূম ,পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া সহ বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন শহরের স্টেশনের সামনে, কোথাও বাজারের মধ্যে ভোর বেলায় মায়েরা মাজায় কাপড় জড়িয়ে, কোথাও যুবকরা হাতে একটা টিফিন কৌটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যতবেলা বাড়ছে মায়ের টিফিন বক্সের খাবার কমছে ,আর যত খাবার কমছে আমার মায়ের, শ্রমিকের মজুরি তত কমছে ,কারণ  শ্রমিকের কাজ চাওয়ার লাইন যত বড় হবে শ্রমিকের বেতন তত কমবে, এই ব্যবস্থা চায় কাজ না পাওয়ার সংখ্যা বাড়ুক। 
রাজ্যের শাসক দল আর কেন্দ্রের শাসক দলের মধ্যে নীতির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। একটা দল দেশ বিক্রি করছে আর একজন রাজ্য লুট করছে। কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য কৃষকরা এগারো একর জমি দিয়েছিল, সেই জমিকে আদানি গোষ্ঠীর হাতে বিক্রি করে দিল  সরকার‌। আমরা টাটার পক্ষেও নয় আমরা বাটার পক্ষেও নই আমরা কাজ পাওয়ার পক্ষে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, ব্যাঙ্ক, এলআইসি ভারত সরকার তুলে দিতে চাইছে। বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে পুঁজিপতিদের হাতে। এক সময়ে মুদির দোকানে আর চাল ডাল পাওয়া যাবে না, আদানি আম্বানির রাইস মিল থেকে ২৭ টাকার চালকে ২৭০ টাকায় কিনতে হবে। দেশের সরকার  কলকারখানা, রেল, বিমান, ব্যাঙ্ক, বিমা, খনিজ সম্পদ,সমুদ্র সৈকত, গোটা দেশটাকেই বিক্রি করছে অন্যদিকে রাজ্যের সরকার বেকার ছেলেদের ভবিষ্যৎ বেচে দিচ্ছে।
আর হাতে ধারিয়ে দিয়েছে বাটি! তাই তো স্কুলের সামনে ভিড় না হয়ে ভিড় হচ্ছে মন্দিরের সামনে! ভিড় হচ্ছে স্টেশনের সামনে! এখন ঠিক করতে হবে এই বেকার ছেলেদের হাতে বাটি নিয়ে ঘোরাবেন না এই সিস্টেমটার পরিবর্তন করবেন? যে ব্যবস্থার পরিবর্তন করলে, যে হাতে বেকাররা বাটি ধরছে সে হাতে বেকাররা কাজ ধরবে। এই সিস্টেমটার পরিবর্তন করলে কৃষক ফসলের দাম পাবে। মা বোনেরা সম্মান পাবে। বেকার ছেলেরা কাজ পাবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। স্কুল বন্ধ হবে না। স্কুলের বাইরে শিক্ষক এবং ছাত্রদের ভিড় বাড়বে। এই সিস্টেমের পরিবর্তন করলে ১০০ দিনের কাজটা ২০০ দিনের হবে। কাজের মজুরি বাড়বে। না খেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত্রে অন্ধকারে বাড়িতে খাবার দিয়ে বেরোতে হবে না। খাবার আপনার বাড়িতে আসবে। এই সিস্টেমটার পরিবর্তন করলে মাইক্রোফিনান্সের টাকা নিয়ে আমার মা বোনেদেরকে কেউ তার স্বামীর তার ছেলের ডেথ সার্টিফিকেট চাইবে না। বাড়িতে পৌঁছে যাবে কাজের একখানা খাম। যে খামের ভেতরে লেখা থাকবে আমার বাংলার অসংখ্য মা-বাবার তিল তিল করে জমিয়ে রাখা স্বপ্নের মিছিল।
বিজেপি ও আরএসএস সমান্তরালভাবে বিভিন্ন জাতি এবং জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ সৃষ্টি করে নিজেদের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। বিভাজনের এই রাজনীতিকে মদত দিচ্ছে তৃণমূলও। তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ এই রাজ্যে তারা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে জায়গা করে দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। 
রাজ্যে তৃণমূলের ইট খসে যাচ্ছে। ছিল তৃণমূল রুখতে বিজেপি, বিজেপি-কে রুখতে তৃণমূলের ন্যারেটিভ। এখন তা ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে। নদী দিয়ে অনেক জল চলে গেছে। রাজনীতির প্রবহমান বয়ে চলা ঘটনা রাজনীতির মুহূর্ত বদলে গেছে। এখন পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীরা সামনের দিকে এগচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক দল লুটের জয় পেয়েছে। কিন্তু বিরাট প্রতিরোধের মুখেও পড়েছে। গণতন্ত্রের রাস্তাকে চওড়া করতে এগিয়ে এল শ্রমজীবী অংশের যুবরা, আমার মা-বোনেরা, রাজিবুল, মনসুর, রওশন ,পুলক ,শুকুর, রিন্টুরা এগিয়ে এলো। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাধারণ মানুষ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। কী করে ভোট রক্ষার জন্য লড়াই করতে হয়, কী করে বেকারের কাজের অধিকারকে ছিনিয়ে আনার জন্য হাজার কিলোমিটার দূর থেকে জেনারেল বগিতে চেপে যাতায়াত করে উপার্জন বন্ধ করে গ্রামে এসে প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়তে হয়। আবার নির্বাচনের পর কেউ পুনে, কেউ কেরালা,কেউ মহারাষ্ট্রে চলে গেলেন পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে। এরা শুধু এসেছিল গ্রামের সরকারটা যেন মানুষের সরকার হয়। তার ছেলে মেয়েটা যাতে সাবধানে স্কুলে যেতে পারে তার স্ত্রী যেন সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে, তার মা বাবা যেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, চোরেদেরকে পঞ্চায়েত থেকে তাড়িয়ে জনগণের প্রতিনিধিকে পঞ্চায়েতে বসাতে পারে এই এক বুক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল। কেউ সফল হয়েছে বুকের জ্বালা মিটেয়েছে ,আবার কোথাও দুষ্কৃতীদের গুলিতে বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে হয়ে গিয়েছে, তবুও লড়াই ছাড়েনি। এই লড়াই-ই আমাদের শিক্ষা। 
এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের লড়াইয়ের বার্তা ছড়িয়ে দিতে, কাজের দাবিতে, দুর্নীতিতন্ত্রের  অবসানের দাবিতে, সাম্প্রদায়িকতার শক্তিকে রুখে দেবার শপথে বাংলার যুবরা পথ হাঁটবেন। এই দেশের বিপ্লবী যুব সংগঠন ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের হাজার হাজার কর্মীরা নামবেন। আমাদের সেই বার্তার ব্যাটন নিয়ে সংগ্রামের চওড়া রাস্তার চওড়া মিছিলে পা মেলাবে লক্ষ লক্ষ স্বপ্নালু চোখের যুবরা। একবুক আশা আর চোখ ভরা সত্যিকারের স্বপ্নের সত্যিকারের ভবিষ্যতের বাস্তবতা খোঁজার তাগিদ পৌঁচ্ছে দেবে সঠিক গন্তব্যে। এ পথে সোজা থেকে দাঁড়িয়ে লড়াই লড়তে পারলে  জীবনের প্রতিষ্ঠার নতুন ভবিষ্যতের আলো ঝলমলে সকাল আছে।
প্রস্তুত গোটা রাজ্যের পাহাড় থেকে সাগরের বিপ্লবী যুব আন্দোলনের নেতারা। নেতা মানে কাকদ্বীপের ছোট্ট গ্রামের যুবদের যে নেতৃত্ব দেন, পুরুলিয়ার কিংবা ঝাড়গ্রামের পাহাড়ে জঙ্গলে যে সংগঠনের একটা একটা ফুল দিয়ে বিরাট সংগঠন নামের মালাটা প্রতিদিন বুনছেন, দার্জিলিঙে চা বাগানে মজুরি না পাওয়া সেই যুব যে মজুরির দাবিতে যুবদের সংগঠিত করছেন, আমাদের সেই নেতারা হাঁটবেন। হাঁটবেন অধিকারের জন্য। হাঁটবেন হকের দাবি যারা চুরি করছে, বিক্রি করছে, লুট করছে, হত্যা করছে তাদের বিচারের দাবিতে, ইনসাফের দাবিতে। ৩ নভেম্বর কোচবিহারে যখন ভোরের লাল সূর্য উঠবে ঠিক তখনই যুব আন্দোলনের কর্মীরা লাল তারায় সাদা পতাকা নিয়ে মানুষের যন্ত্রণার কথা বলার জন্য ইনসাফ যাত্রা শুরু করবে। এই ইনসাফ যাত্রা বাংলার সমস্ত জেলা হয়ে ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডের ময়দানে হাজির হবে। হবে ঐতিহাসিক  ব্রিগেড সমাবেশ। যৌবনের ডাকে জনগণের সমাবেশ। 
এই ইনসাফ যাত্রা বেকারের ঘামের হিসাব চাইতে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বুঝে নেবার। মানুষের রুটি রুজির লড়াইকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। চা বাগানের শ্রমিকদের যন্ত্রণা তুলে ধরতে। ছেলের খুন হয়ে যাওয়া মায়েদের হাতে ছেলের রক্তের হিসাব তুলে দেবার জন্য। ধর্ষিতা মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে প্রতিরোধের আগুন জ্বালার জন্য। বেকার যুবক, কৃষক আত্মহত্যা বন্ধ করার জন্য। কোনও ভাগের রাজনীতি নয় মানুষের ভাতের লড়াইকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইনসাফ যাত্রা।
যুবকর্মীরা পৌঁছে যাবেন সব মানুষের বাড়িতে, আর সব মানুষের বাড়িতেই মানুষের যন্ত্রণার কথা বলবে। কোনও দেওয়াল থাকবে না দুষ্কৃতীদের হাতে, সমস্ত দেওয়ালের দখল নেবে যুবকর্মীরা যে দেওয়ালে লেখা থাকবে যুব জীবনের যন্ত্রণার কথা। এই ব্রিগেডের ময়দানে হাজির হবে ছাত্র যুব কৃষক শ্রমিক ডাক্তার উকিল সরকারি কর্মচারী রিকশাচালক ভ্যানচালক টোটো চালক রেল ইউনিয়নের কর্মী সব অংশের মানুষের কাছে আমরা আহ্বান জানিয়েছি।
এই ব্রিগেড ভবিষ্যতের পথ দেখানোর ব্রিগেড। সম্ভাবনার বাঁকের মুখে সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের ব্রিগেড। ইনসাফ চাইতে চাইতে এগতে এগতে প্রকৃত ইনসাফের পথ খোঁজার ব্রিগেড।।

Comments :0

Login to leave a comment