Insaf rally Birbhum

স্পর্ধার ইনসাফ যাত্রায় নজরদারি পুলিশের, শামিল দুঃসাহসী রেবিনা, আমিনারা,শহীদের স্ত্রীও

রাজ্য

রণদীপ মিত্র: লাভপুর 
 

ভোরেই উঠেছেন। তারপর ট্রেনে, বাসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। সঙ্কল্প ছিল, অংশ নেবেন ইনসাফ যাত্রায়। তাই করেছেন রেবিনা খাতুন। নলহাটির মাঠ কলিঠা থেকে পঞ্চাশ কিমি দূরের আহমেদপুরে কামারশাল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ক্রাচে ভর দিয়ে। শৈশবে দুর্ঘটনায় এক পা খোয়ানো রেবিনা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রী। ক্রাচে ভর দিয়েই  অসুবিধা হেলায় উড়িয়ে হেঁটেছেন প্রায় তিন কিমি পথ। রেবিনা একা নন, সঙ্গে ছিলেন পোলিওর থাবায় দু’পা ছোট হয়ে যাওয়া আমিনাও। 
স্পর্ধার ইনসাফ যাত্রার বিশতম দিনে এই রেবিনা, আমিনা, স্নিগ্ধাদের মতো ‘বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন’ কিশোরীদের জেদ প্রত্যয় বাড়িয়েছে পদযাত্রার। সেই প্রত্যয় নিয়েই অগুণিত মানুষের ভিড়ে ঠাসা এই পদযাত্রা ক্রমশ পেরিয়েছে শাসক সন্ত্রাসে দীর্ণ লাভপুর থেকে নানুর। যে যাত্রাপথে যৌবনের এই লড়াইয়ে একাত্ম হয়েছেন নানুরের শহীদ বাদল শেখের স্ত্রী জরিনা বিবি। নাতিকে নিয়ে তিনি শামিল হয়েছিলেন নানুরের ইনসাফ যাত্রায়। অবশ্যই শাসকের শাসানির আশঙ্কা নিয়ে। 
ইনসাফ যাত্রা বীরভূমে প্রবেশ করেছিল মঙ্গলবার। বুধবার সেই যাত্রা শুরু হয় আহমেদপুরের কামারশাল মোড় থেকে। যেখানে পদযাত্রীরা জড়ো হতেই ক্রাচ হাতে রেবিনা আর কষ্ট নিয়েও আমিনা এগিয়ে আসেন পদযাত্রীদের কাছে। হাতে পরিয়ে দেন হলুদ-নীল রাখী। শুরু করেন হাঁটতে। দুই কিশোরীই ভলিবলের প্যারা অলিম্পিকে জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে ফেলেছেন। তাঁদের এত কষ্ট করে হাঁটার কারণ কি ? প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট জবাব, ‘‘ভালোভাবে বাঁচতে চাই। আমাদের নিয়ে ছেলেখেলা করছে সরকার। লেখাপড়া শিখেছি, খেলাধুলা করছি। কিন্তু মাথা থেকে পেটের ভাতের চিন্তা যাচ্ছে না। প্রতিবন্ধী ভাতা হাজার টাকায় কি হবে ? একশো দিনের কাজে আমাদের অগ্রাধিকার কই ? আমাদের মতো বহুজন এখনও পরিচিতি পত্র পায়নি। এসবের জন্যই তো লড়াই।’’ 
দর্শনে স্নাতকোত্তরের ছাত্রী রেবিনা, স্নাতকের ছাত্রী আমিনা-দু’জনেই দিনমজুর পরিবারের সন্তান। দুই কিশোরীর হার না মানা জেদই এদিন পাথেয় হয়েছিল ইনসাফ যাত্রার। যে যাত্রা আহমেদপুর ছাড়িয়ে এরপর পৌঁছেছিল লাভপুরের। লাভপুরের গোরুরহাটে তারাশঙ্করের প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের যাত্রাপথ। সেই যাত্রাপথে শামিল হয়েছিলেন তৃণমূলী সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত হাতিয়ার এক ফেরিওয়ালা। লুকিয়ে এসেছিলেন। গাঁয়ের সিভিককেই পুলিশ আবার দায়িত্ব দিয়েছিল নজরদারির জন্য। সেই সিভিককে দেখিয়েই ওই ফেরিওয়ালা জানান, ‘‘ওই দেখুন ছবি তুলছে। কে কোন পাড়া থেকে এসেছে সব খবর দেবে। এই তো আমি মোবাইল সারাবার নাম করে এসেছি। আমাকে দেখলেই ফের অশান্তি করবে।’’ ফেরিওয়ালার পাশেই ছিলেন ধনডাঙ্গার এক কৃষক। হাতে থাকা ওষুধ দেখিয়ে তার বক্তব্য, ‘‘হাসপাতালে ওষুধ নেওয়ার নাম করে এসেছি। আসতে চাইছিল তো অনেকেই। কিন্তু এখনও সবাই সাহস জোটাতে পারেনি।’’ শাসকের লালচোখে অবরুদ্ধ জনপদের এই দুই বাসিন্দা অবশ্য সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, ‘‘যারা অত্যাচার চালাচ্ছে তারাই এবার ভয় পেয়েছে। এত অন্যায়, এত অবিচার, এত লুটপাট করেছে যে এবার ভয় ঢুকেছে ওদের মনে। আমরাও এবার একজোট হচ্ছি।’’ 
সদ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে লাভপুরজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল তৃণমূল, সেই লাভপুরই এদিন দেখেছে লাল-সফেদ ঝান্ডার দৃপ্ত মিছিল। রাস্তার দু’পাশে মানুষ ভিড় করেছেন, বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়েছেন যৌবনের স্পর্ধাকে চাক্ষুষ করতে। সভা হয়েছে লাভপুরের পুরানো বাসস্ট্যান্ডে। সেই সভায় দাঁড়িয়ে ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদিকা মীনাক্ষী মুখার্জি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘‘তিন ভাইকে পিটিয়ে খুনের সাক্ষী এই লাভপুর। সালিশি সভায় আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণের নিদান দেওয়ার সাক্ষী এই লাভপুর। হাজার হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করার সাক্ষী এই লাভপুর। তারাশঙ্করের লাভপুর আজ ভীত, সন্ত্রস্ত। ভয় পেতে পেতে মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এবার পালটা ভয় ধরানোর পালা। ভয়ের ঘরে ভয় ঢোকাতে হবে। মানুষই তা করবে। তখন তৃণমূলের চোর, জোচ্চর, লেঠেলরা লেজ গুটিয়ে পালাবার পথ পাবে না।’’ 
লাভপুরের পর ইনসাফ যাত্রা পরবর্তী ঠিকানা ছিল নানুরের কীর্ণাহার। যে নানুরে শহীদের সংখ্যা অসংখ্য। সেই শহীদের রক্তে রাঙা চণ্ডীদাসের নানুরও সাক্ষী হয়েছে অত্যাচারীদের ধ্বংস করার বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলা যৌবনের তেজের। সেই ভিড়ে এদিন মিশেছিলেন ২০২১ সালে নভেম্বর বিপ্লবের দিনে নিজের বাড়িতে লাল পতাকা তোলার অপরাধে নৃশংসভাবে খুন হওয়া বাদল শেখের স্ত্রী জরিনা বিবি। সেখানে দাঁড়িয়ে মীনাক্ষী মুখার্জি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, ‘‘বাদল শেখ, আনন্দ দাসদের মতো অসংখ্য শহীদের রক্তে আমাদের কাঁধ চওড়া হয়েছে। সেই কাঁধ বেইমানি করবে না। ছলে বলে কৌশলে তৃণমূল ও বিজেপি দু’জনেই মানুষের টুঁটি টিপে ধরেছে। আমরা লড়ে যাব মানুষকে বাঁচাতে।’’ লাভপুর ও নানুরে হওয়া দুই সভায় এছাড়াও বক্তব্য রেখেছেন ধ্রবজ্যোতি সাহা, সফিকুল সর্দার, তনুময় হালদার, সোহম মুখার্জিরা। সভাপতিত্ব করেছেন আকবর আলি।

 

Comments :0

Login to leave a comment