আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রকল্পের চৌহদ্দির মধ্যে এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক দল, এক নেতার ধারণাকে যেভাবে শাসন ব্যবস্থার মর্মবস্তু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে আদতে সেটাই ভারত রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নির্মূল করার প্রাথমিক পদক্ষেপ। আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের ছাঁকনি পেরিয়ে যে গণতন্ত্রের বিকাশ সেখানে কোনও ব্যক্তি মানুষই পুরোপুরি নির্ভুল, কলুষমুক্ত, সমালোচনা বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। তাই গণতন্ত্রে স্বৈরতন্ত্রী বা একনায়কের কোনও জায়গা নেই। কিন্তু মোদীর নেতৃত্বে শাসকদল এবং সরকারের যে রূপান্তর ঘটেছে সেখানে দলে ও সরকারে একজনই শেষ কথা বলার অধিকারী। নেতা একজন। বাকিরা সব নেতার জয়ধ্বনি করা ভক্ত ও অনুগত। নিঃশর্তে, নিঃসঙ্কোচে, অন্ধের মতো নেতার আদেশ পালন ও নেতাকে অনুসরণ করাই ভক্তদের একমাত্র। নেতাকে প্রশ্ন করার বা অন্য কিছু বলার বা ভাবার অধিকার তাদের নেই। ধর্ম ও রাজনীতির মিশেলে এমন এক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সচেতনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যেখানে ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছে দল আর নেতা উঠতে চাইছেন ধর্মগুরুদেরও গুরু। এমনকি শঙ্করাচার্যরাও এহেন রাজনৈতিক ধর্মগুরুর কাছে কল্কে পান না।
ধর্ম মানে যুক্তি ও বিজ্ঞান বর্জিত অন্ধ বিশ্বাস। ধর্মের মোড়কে রাজনীতির প্রতিষ্ঠা মানেও তাই রাজনৈতিক অন্ধ বিশ্বাস। এহেন রাজনীতিতে ধর্মভীরু তাই প্রধান অনুসঙ্গ হয় অদৃষ্টবাদকে প্রতিষ্ঠিত করে। নরেন্দ্র মোদীরা রাজনীতিকে এভাবে ধর্মান্ধতার আখড়ায় পরিণত করে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের আড়ালে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে একদলীয় স্বৈরাচারী কবজায় আনতে চান।
গণতন্ত্র মানে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভোট এবং সরকার গড়া নয়। গণতন্ত্রের পরিধি আরও সুদূর প্রসারিত। গণতন্ত্র মানে প্রতিটি নাগরিক সত্তার স্বাতন্ত্র্য। ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, ধর্মান্তরের স্বাধীনতা এবং কোনও ধর্মে বিশ্বাস না থাকার স্বাধীনতা। গণতন্ত্র মানে স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে নির্দ্ধিধায় মত প্রকাশ, সমালোচনা, বিরোধিতা ও ভিন্ন মত পোষণের অধিকার। গণতন্ত্র মানে খাদ্য, পোশাক, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি বাছাই করার অধিকার। গণতন্ত্র মানে সব ধর্মের, জাতিগোষ্ঠীর, ভাষার, সংস্কৃতির মানুষের ঐতিহ্যকে বহন করে নিজেদের মতো করে বাঁচার অধিকার। এই হাজারো স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সুরটা ভারতবর্ষ। ভারতের গণতন্ত্র এই ভারতবর্ষকেই সুরক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর।
মোদী সরকার এর মূল্যেই লাগাতার কুঠারাঘাত করে তাকে নির্মূল করার অভিযান চালাচ্ছে। ইউপিএ, এনএসএ, পিএমএলএ প্রভৃতি আইনকে কঠোর থেকে কঠোরতম করে যাবতীয় ভিন্নসুর ও বিরোধিতার কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চাইছে। শিক্ষক, অধ্যাপক, গবেষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, রাজনৈতিককর্মী থেকে শুরু করে সরকারের সুরে সুর না মেলানো লোকদের বিনাবিচারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আত্মসমর্পণ না করে স্বাধীন নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাকে যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে আছেন তাদের ঠিকানা আজ জেল। শ্রমিক, কৃষক সহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের দমন করা হচ্ছে নির্মমভাবে। সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও অধিকার নেই। সংসদও চলছে একদলীয় হুলিয়ায়। কোনও আলোচনা ছাড়া, বিরোধীদের মতামত ছাড়া একতরফা পাশ হয়ে যাচ্ছে যাবতীয় বিল। এমনকি বিরোধী সদস্যদের বহিষ্কার করে বিল পাশের পথ মসৃণ করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের স্তম্ভ হিসাবে পরিগণিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে করে তোলা হয়েছে সরকারের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানে। সিবিআই, ইডি, আইটি’কে শাসকদলের শাখায় পরিণত করে বিরোধী নেতা-কর্মীদের ভাঙিয়ে শাসক দলে ভেড়ানোর অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনৈতিকভাবে রাজনৈতিক তোলাবাজিতে সংগৃহীত বিপুল অর্থ ঘুষ হিসাবে ব্যবহার করে বিরোধী দলের বিধায়ক কিনে সরকার দখল করা হয়েছে। এক দলের হয়ে ভোটে জিতে বিজেপি’র কাছে বিক্রি হচ্ছে শত শত কোটি টাকায়। জনমতের কুৎসিত ধর্ষণ ছাড়া একে আর কি বলা যেতে পারে।
মোদীর নেতৃত্বে ভারতের গণতন্ত্রের বলাৎকার চলছে এভাবেই। আর কিছুদিন সুযোগ ভারতের বুকে গণতন্ত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। সেটা কোনও অবস্থাতেই হতে দেওয়া যায় না। আসন্ন নির্বাচনেই গণতন্ত্র নাশা শক্তিকে সরিয়ে গণতন্ত্রের শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
Democracy India
পুনর্জীবন পাক ভারতের গণতন্ত্র
×
Comments :0