CPI-M STATE CONFERENCE

প্রত্যয়ী লড়াইয়ে বার্তা, ‘হামি পার্টি গড়ছু’

রাজ্য

 ভাঙনে বিধ্বস্ত এলাকা। সিপিআই(এম) কর্মীরা গিয়েছেন সেখানে। ভাঙন প্রতিরোধে পাঁচটি দাবির কথা গ্রামে প্রচার করাই উদ্দেশ্য। গ্রামবাসীরা এগিয়ে এলেন। পার্টি কর্মীদের পাঁচ দফা দাবির কথা শুনলেন। তারপর তাঁরাই বদলে দিলেন পার্টির দাবি। সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, তফসিলি জাতির মানুষ গ্রামে প্রধানত। কিন্তু সবাই মিলে ঠিক করে দিলেন, এখন বাঁধ মেরামতির দাবিই প্রধান দাবি।
সিপিআই(এম)’র পাঁচ দফা দাবি হয়ে গেল ছ'দফা। পার্টির দাবি, আন্দোলনের ডাক হয়ে গেল গ্রামের গণআন্দোলনের দাবিসনদ। 
সিপিআই(এম)’র রাজ্য ২৭তম সম্মেলনে রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদনের খসড়া শনিবার পেশ করেছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। শনিবারই সেই প্রতিবেদনের উপর আলোচনা শুরু হয়েছিল। রবিবারও সারা দিন প্রতিনিধিরা আলোচনা করেছেন। সেই পর্বেই মালদহ জেলার প্রতিনিধির আলোচনায় এই অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে। জেলার একদিকে আরএসএস হিন্দুত্ববাদী প্রচার চালাচ্ছে। আরেকদিকে সংখ্যালঘু মুসলিম মৌলবাদীরাও বিভাজনের লক্ষ্যে উসকানি দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলায় সেই সময়েই মানুষের দাবিতে আন্দোলন চলছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়েই এই তৎপরতার কিছু সুফল দেখা গিয়েছে। 
এই অভিজ্ঞতা শুধু সীমান্তের সেই জেলার নয়। সিপিআই(এম)’র নিজস্ব শক্তির বৃদ্ধির চিত্রে মালদহের পাশে হাজির পশ্চিমাঞ্চলের জেলাও। পশ্চিম মেদিনীপুরের অভিজ্ঞতা বলছে, ‘‘২০১১’র বিধানসভা নির্বাচনের পর জেলার যে এলাকাগুলিতে পার্টি দারুণ শক্তিশালী ছিল, সেখানে মারাত্মক আক্রমণ হয়েছে। সবাই জানেন সেই সব কথা। শহীদ হয়েছেন অনেকে। ঘরছাড়া হয়েছেন, মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন পার্টিকর্মীরা। আমরা গত কয়েক বছরে ছক বাঁধা পথের বাইরে আন্দোলনের রূপরেখা মেনে এগিয়েছি অনেক ক্ষেত্রে। কখনও ভেড়ি বানানোর বিরুদ্ধে, জমি দখলের বিরুদ্ধে যেমন আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে, তেমনই অনেক ব্লকে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, রেগার মজুরি, আবাসের ঘরের টাকার দাবিতে ব্লক অফিস ঘেরাও করা হয়েছে। পুলিশের বাধা ভেঙে, শেকল ছিঁড়ে ব্লক অফিসে ঢুকে পড়েছেন আন্দোলনকারীরা। গ্রামের মানুষ ছিলেন সেই আন্দোলনকারীদের সামনে।’’ এই প্রসঙ্গেই এসেছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে জাল স্যালাইনে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্র ও যুব আন্দোলনের কর্মীদের দুর্দান্ত লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার কথাও। 
এই জেলার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, আরএসএস’র তৎপরতা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে মূলত বাংলাদেশের ঘটনায় ‘আক্রান্ত হিন্দুরা’ বলে প্রচার চালিয়ে তারা কেশিয়ারি থেকে গোয়ালতোড়, লালগড় সীমানায় ভীমপুর পর্যন্ত গ্রামবাসীদের মধ্যে বিভাজন আনতে জোরদার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীরা স্থানীয় ও আদায়যোগ্য দাবিতে যখন আন্দোলন গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয়েছেন, তখন সাড়া মিলছে, সাফল্যও আসছে। 
এই মানুষ কি ভোট দেবেন পার্টিকে? স্বভাবতই তা বিচারের বিষয়। খসড়া প্রতিবেদনে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়েই বিভাজনের মেরুকরণ ও বাইনারিকে ব্যবহার করে শ্রেণি আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টায় লিপ্ত। এই দুই শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে, জনবিচ্ছিন্ন করতে হবে। রাজ্যে শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের লড়াই ও সমগ্র দেশে শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের লড়াই এক সূত্রে গাঁথা।... ২০২৬ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে শ্রেণিশক্তির ভারসাম্যের গুরুতর পরিবর্তন ঘটাতেই হবে।’’
সেই শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য বদলে দেওয়ার লড়াই চলছে। বাধাও আসছে। শুধু সাম্প্রদায়িক শক্তির দিক থেকেই নয়, অন্যান্য দিক থেকেও। 
কী শোনাচ্ছেন পুরুলিয়ার প্রতিনিধি? তিনি বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ‘চোর ধরো জেল ভরো’ স্লোগানে সাড়া দিয়েছিল গ্রাম। গ্রামবাসীরা নিজেদের গ্রামে আমাদের ডেকে পাঠাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘এখানেও মিছিল করো, আমরা থাকবো।’ পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আমরা দেখলাম, হঠাৎ কুর্মি সমাজের নামে আলাদা প্রার্থী দেওয়া শুরু হলো। আমরা এমনও দেখলাম, যেখানে তৃণমূল কিংবা বিজেপি প্রার্থী দিচ্ছে, সেখানে তারা কিছু বলছে না। যেখানে আমরা প্রার্থী দিতে গেলাম, অনেক জায়গায় বলল, ‘তোমরা প্রার্থী দেবে না।’ পশ্চিমাঞ্চলে নানাভাবে নানা অংশকে ভিত্তি করে পৃথক জাতিসত্তার নামে বাইনারি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।’’ সেই তালিকায় ওবিসিদের শংসাপত্র, আদিবাসীদের জমির মতো বিষয় যেমন আছে, তেমনই রেলের সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলনও আছে। 
আছে খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির প্রশ্নে আন্দোলনের অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞতা। যে জেলা এই ক্ষেত্রে প্রায় একশো জায়গায় আন্দোলনের অভিজ্ঞতার নির্যাস তুলে ধরেছে, সেই হুগলীর প্রতিনিধির আলোচনায় এসেছে চটকলের লড়াইয়ের কথা। ১৩টি চটকল জেলায়। গঙ্গার অববাহিকায় নরম মাটিতে কঠিন মনের চটকল শ্রমিকদের সংগঠকদের ‘গেট বাহার’ করে দিয়েছে তৃণমূলের বরাভয় পাওয়া মালিকপক্ষ। সেই গেটের বাইরে বের করে দেওয়া শ্রমিক, তাঁরা নেতাও, তাঁরা লড়াইয়ের স্পৃহা হারাননি। 
লড়াই জারি আছে। এই অমাবস্যায় সোনালি রেখার মতো জেগে আছে প্রত্যয়— কালিম্পঙের মহিলা প্রতিনিধি নেপালি ভাষায় যাকে বলেছেন, ‘‘হামি পার্টি গড়ছু।’’
তিনটি মাত্র শব্দ। যে এলাকায় খুন করে লাল ঝান্ডাকে মুছে দিতে চেয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সঙ্ঘ যেখানে অনেক দিন আগে কাজ শুরু করেছে, যেখানে মাওবাদীরা তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছেছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে সাহায্য করতে, সেই ২০০৭-০৮ সালে, সেই ভূখণ্ডের মহিলা লাল ঝান্ডার সম্মেলনে এসে জানিয়ে দিলেন, ‘‘পার্টি আমরা গড়বই।’’
সিপিআই(এম)’র অন্তিম সনেট কে লেখে? উত্তর দিনাজপুর বলছে, এতভাবে ধর্মের বিভাজনের চেষ্টা হচ্ছে! তবু আমরা, আমাদের কর্মীরা মার খাওয়া, মিথ্যা মামলার আশঙ্কা সত্ত্বেও নানা স্থানীয় বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে শহীদ হয়েছেন কমরেড মনসুর। কিন্তু ভয় পাননি পার্টিকর্মীরা।’’ 
এত প্রত্যয়ের মানচিত্রে নিরাশার জমি, রাজত্ব? না, নেই।

Comments :0

Login to leave a comment