Kuntal Ghosh

অভিষেকের কথাই ধৃত কুন্তলের গলায়

রাজ্য

 দলের প্রকাশ্য সভা থেকে ‘বার্তা’ দিচ্ছেন নেতারা। জেলে বসেই সেই বার্তা শুনছেন নিয়োগকাণ্ডে ধৃতরা। তারপর আদালতে পেশ করার সময় পুলিশি সহযোগিতায় সংক্ষিপ্ত ‘সাংবাদিক বৈঠক’  করে দলের বার্তাই তুলে ধরছেন ধৃতরা!
নিয়োগ দুর্নীতিতে জেলবন্দি ধৃতদের আদালতে পেশের সময় এখন রোজকার এমন চিত্রই যেন দস্তুর!
যা দেখা গেলে বৃহস্পতিবার ব্যাঙ্কশাল ও আলিপুর কোর্ট চত্বরে।
বুধবারই শহীদ মিনারে দলীয় সভা থেকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জি অভিযোগ করেছিলেন কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর জেরায় তাঁর নাম বলতে চাপ দিচ্ছে। অভিষেক অভিযোগ করেন- ‘‘এই তো মদনদা জেলে ছিলেন। কুণাল ঘোষও জেলে ছিলেন। এঁদের বলা হয়েছিল, আমার নাম নিলেই ছেড়ে দেবে। আমার জন্য আলাদা আইন করার দরকার নেই।’’
চব্বিশ ঘণ্টাও কাটলো না। নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত, সদ্য ‘বহিষ্কৃত’ যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষকে এদিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে পেশ করা হয়। আদালতে ঢোকার মুখে প্রিজন ভ্যান থেকে নামার পরেই সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তে ‘বাইট’ও দিলেন চাকরি চুরিকাণ্ডে ধৃত কুন্তল ঘোষ। 
কুন্তল কী বললেন? ‘‘বিভিন্নভাবে ভয় দেখিয়ে আমাদের থেকে নেতাদের নাম বার করার চেষ্টা করছে এজেন্সি। কিন্তু, আমরা মা মাটি মানুষের আদর্শে বিশ্বাসী। আমরা এই ধরনের ভয়কে পাত্তা দিই না। কেন্দ্রীয় এই সংস্থাগুলি আমাদের হেনস্তা করছে’’। এখানেই শেষ নয় তৃণমূলের এই নেতা আরো বললেন- ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু বলা মানে আমাদের বুক চওড়া হওয়া। এজেন্সি দলের নেতাদের নাম বলতে চাপ দিচ্ছে।’ প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনাকে কি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বলার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে?’’ কুন্তল বলেন, অবশ্যই।
বুধবারই প্রায় একই কথা বলেছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি। বৃহস্পতিবারই জেলবন্দি চাকরি বিক্রিকাণ্ডে অভিযুক্তের বয়ানে সেই সুর।
তবে তাৎপর্যের হলো, সারদা কেলেঙ্কারির সময় মমতা ব্যানার্জির পুলিশের হাতেই ধৃত তৎকালীন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষকে এমন যত্ন করে পুলিশ কোনোদিন সাংবাদিক বৈঠক করতে দেয়নি। বরং আদালতে ঢোকার সময় বা বেরোনোর সময় কুণাল ঘোষ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই পুলিশ নিজেই প্রিজন ভ্যানে বাড়ি মারতো যাতে কথা না শোনা যায়। বর্তমান তৃণমূলের মুখপাত্র প্রতিদিন নিয়ম করে মমতা ব্যানার্জি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে সারদাকাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনতেন। সারদা থেকে কেউ যদি সবথেকে বেশি সুবিধা নিয়ে থাকেন তা হলো মমতা ব্যানার্জি, এমন সব বিস্ফোরক অভিযোগও করতেন কুণাল।
তবে কুন্তল বা পার্থ চ্যাটার্জির এমন বাধার মুখে পড়েননি। কেন না ‘বহিষ্কৃত’ হয়েও প্রতিদিন শাসক তৃণমূলের পক্ষেই, তৃণমূলের সুরেই কথা বলছেন।
ইতিমধ্যে ইডি আদালতে কুন্তল ঘোষের নিয়োগ দুর্নীতির টাকার ব্রেক-আপও তুলে ধরেছে। এর মধ্যে সংগঠক শিক্ষকদের নিয়োগ, স্থায়ীকরণের জন্য ১০ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়েছিল, উচ্চ প্রাথমিকে অবৈধ নিয়োগর জন্য ৩ কোটি ৩০ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা, ২০১৪’র টেট পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং চাকরির অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ৫ কোটি ২৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা তোলা হয়েছিল। শুধুমাত্র এই যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদককে টাকা দিয়ে ৩২৫ জন টেট পরীক্ষার্থী খালি খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করেছিল। মাথা পিছু ১ লক্ষ টাকা করে সেই খাতে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা তুলেছিল কুন্তল। 
তবে কুন্তল ঘোষ এখন ‘অভিষেক ব্যানার্জির নাম বলতে চাপ দেওয়া হচ্ছে’ দাবি করলেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র দাবি এগুলো সবই লোক দেখানো। কুন্তল কোটি কোটি টাকা তুলেছে। জেরাতে সবই স্বীকার করেছে। দলের শীর্ষ মহলে ভাগ দিতে হতো তাও স্বীকার করেছে। আদালত ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ফের এই প্রতারকের জেল হেপাজতের নির্দেশ দেয়। 
আবার পার্থ চ্যাটার্জিকেও আদালতে পেশের সময় রিতিমত পুলিশি ব্যবস্থাপনাতেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। নিয়োগকাণ্ডে ধৃত, সিবিআই-ইডি’র কথায় ‘দুর্নীতির কিংপিন’ পার্থ চ্যটার্জিই গত ২৩ মার্চ আদালতে ঢোকার সময় বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির আঙুল তোলেন। তিনি দাবি করেন, সুজন চক্রবর্তী, শুভেন্দু অধিকারি তাঁকে চাকরির জন্য সুপারিশ করতেন, কিন্তু পার্থ চ্যাটার্জি নীতিপরায়ন লোক তাই বেআইনী সুপারিশ কার্যকর করতেন না! 
সেই পার্থ চ্যাটার্জি এদিন পুলিশের আয়োজনে আলিপুর আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের সামনে বলেন- ‘‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জির লড়াই চিরকালই ছিল। বাংলার হয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করা একজন সংগ্রামী নেত্রী। আমি বিনা বিচারে আট মাস ধরে পড়ে রয়েছি। কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। মমতা ব্যানার্জির উপর আমার ১০০ শতাংশ বিশ্বাস রয়েছে।’’
ইডি’র তরফে আদালতে দাবি করা হয়েছে, ইতিমধ্যে ধৃত কুন্তল ঘোষ, শান্তনু ব্যানার্জির সঙ্গে পার্থ চ্যাটার্জির যোগের তথ্য মিলেছে। শুধু তাই নয় নিয়োগকাণ্ডেই ধৃত প্রমোটার অয়ন শীলের মাধ্যমে চাকরি বেচারা টাকা ভায়া কুন্তল পৌঁছে যেত তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির কাছে। যদিও পার্থ চ্যাটার্জি এই তিনজনকেই চিনতে অস্বীকারে করে সাংবাদিকদের সামনে এদিন বলেন- ‘আমি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতা তৈরি করি। কুন্তল ঘোষ তৈরি করি না।’ আবার আদালতে দাঁড়িয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেন- ‘ইডি কলকাতায় কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। চুঁচুড়া থেকে ধরে আনছে!’
তাহলে কী নিয়োগ দুর্নীতিতে কলকাতার নেতাদের না ধরে জেলার নেতাদের ধরা হচ্ছে কেনো, এমন কোনো ইঙ্গিত কী দিলেন পার্থ চ্যাটার্জি? মেলেনি উত্তর। তবে এদিন আদালতে বেহালা পশ্চিম থেকে তৃণমূলের জনা পাঁচেক লোক এসে পার্থ চ্যাটার্জি জিন্দাবাদ স্লোগানও তোলে আদালতে। তৃণমূল ও মমতা ব্যানার্জির পক্ষে এমন বিরোধীদের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে কাছে বাইট দেওয়ার পরেই এখন আদালতেও তৃণমূলের লোকজন আসা শুরু করেছে!
 

Comments :0

Login to leave a comment