Electoral Bonds

কেন্দ্রীয় এজেন্সির তল্লাশিতে বিজেপি’র ঘরে ২,৪৭১ কোটি

জাতীয়

 ‘ক্রোনোলজি সমঝিয়ে!’ ২০১৮-র সেপ্টেম্বর মাসে হরিয়ানা পুলিশ জমি দখলের অভিযোগে এফআইআর দায়ের করে রিয়েল এস্টেট গোষ্ঠী ডিএলএফ কোম্পানির বিরুদ্ধে। 
২০১৯-র জানুয়ারিতে জমির বেনিয়মের অভিযোগে ডিএলএফ-এর অফিসে সিবিআই তল্লাশি চালালো।
২০১৯-র অক্টোবর ও ২০২২-র নভেম্বরের মধ্যে সেই ডিএলএফ গোষ্ঠী বিজেপি-কে ১৭০ কোটি টাকা দিল বন্ডের মাধ্যমে। (নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তথ্যে ২০১৯-র এপ্রিলের আগে কিছু দেওয়া হলে তার হিসেব নেই)।
৫ মাস পর, ২০২৩-র ১৯ এপ্রিল পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে হরিয়ানার বিজেপি সরকার জানায়, এই জমি হস্তান্তরে ‘কোনও নিয়ম/বিধি লঙ্ঘিত হয়নি’। পাঁচ বছর টানাটানির পর যে বিজেপি জমি-দুর্নীতির অভিযোগ তুলল, তাদের ভোল বদলে গেল!
প্রসঙ্গত, এই জমি ‘কেলেঙ্কারি’ নিয়ে ২০১৯-র লোকসভা ভোটের প্রচারে ঝড় তুলেছিল বিজেপি। কারণ এই জমি হস্তান্তরে ডিএলএফ গোষ্ঠীর সঙ্গেই নাম ছিল সোনিয়া গান্ধীর জামাতা ব্যবসায়ী রবার্ট ভদ্রার নাম। লোকসভার ভোট, হরিয়ানার বিধানসভার ভোট মিটতেই বিজেপি সরকার আদালতকে বলল ‘কোনও নিয়ম ভাঙা হয়নি’। মাঝে অবশ্য ১৭০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে ডিএলএফ গোষ্ঠী বিজেপি’কে দিয়েছে। এই রিয়েল এস্টেট গোষ্ঠী তিনটি সংস্থার নামে সেই বন্ডগুলি কিনেছিল। যার পুরোটাই গেছে বিজেপি-র কাছে। এসবিআই-নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত তালিকায় স্পষ্ট এই ডিএলএফ গোষ্ঠী অন্য কোনও রাজনৈতিক দলকে বন্ডে টাকা দেয়নি। আরও লক্ষ্যণীয়, গুরগাঁওয়ের সেই জমি মামলা ধামাচাপার পর থেকে ডিএলএফ গোষ্ঠীও বন্ড-খয়রাতি বন্ধ করে দিয়েছে। 
শুধু ডিএলএফ গোষ্ঠী নয়, অরবিন্দ ফার্মা, যশোদা হসপিটাল, হেটেরো ড্রাগস, আইএফবি অ্যাগ্রো, কল্পতরু গোষ্ঠী - কেন্দ্রীয় সংস্থার চাপের মুখে বন্ড কিনেছে এমন অসংখ্য প্রমাণ এসে গেছে। সর্বত্র ওই সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে বন্ডের নামে দলের অর্থভাণ্ডারকে মজবুত করা হয়েছে। আর সে কাজে অবশ্যই ‘দাদাগিরি’চালিয়েছে বিজেপি। একটি হিসেব অনুযায়ী সিবিআই, ইডি কিংবা আয়কর দপ্তরের তদন্তের মুখে পড়া ৪১ টি কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি’কে ২,৪৭১ কোটি টাকা যুগিয়েছে। যার মধ্যে ১,৬৯৮ কোটি টাকা বিজেপি’কে দেওয়া হয়েছে এই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির তল্লাশির পরেই। শুক্রবার নয়াদিল্লি প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলেনে বিজেপি-র এই ‘চৌকিদারি তোলাবাজির’বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে নাগরিক সমাজ। রাজনৈতিক দল হিসেবে সিপিআই(এম) ছাড়াও এই নাগরিক সমাজই আদালতে নির্বাচনী বন্ডকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। সেই মামলাকারীদের মধ্যে এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ, সমাজকর্মী জগদীপ ছোকার, আরটিআই কর্মী অঞ্জলি ভরদ্বাজ।
কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে বিজেপি-র পেট ভরানোর তথ্য-তালিকা তুলে ধরে এদিন বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ জানিয়েছেন, অন্তত ৩০টি শিখণ্ডী সংস্থা ১৪৩ কোটি টাকারও বেশি বন্ড কিনেছে। সঙ্গে তিনি ফাঁস করেছেন, নির্বাচনী বন্ডে চাঁদা দিয়ে ওই সংস্থাগুলি সরকারের থেকে ১৭২টি বড় প্রকল্প ও ঠিকা আদায় করেছে। প্রশান্ত ভূষণের অভিযোগ, বন্ডের বিনিময়ে এই কোম্পানিগুলি ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পের বরাত পেয়েছে। এর জন্য তাদের বিজেপি-কে ১,৭৫১ কোটি টাকা দিতে হয়েছে।
প্রশান্ত ভূষণের কথায়, স্বাধীন ভারতে এই নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পই হলো সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি। এটা চারটি বিভাগে করা হয়েছে। তাঁর কথায়, প্রথমটা হলো ‘চান্দা দো, ধান্দা লো’, দ্বিতীয় পদ্ধতিটা হলো ‘হপ্তা-উসুলি’, তিন নম্বরটা হলো ‘ঠেকা লো, রিসওয়াত (ঘুষ) দো’, আর চতুর্থটি হলো ‘ফর্জি (ভুয়ো) কোম্পানি’। 
সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশান্ত ভূষণ বলেন, কেন্দ্রীয় সংস্থা হানা দেওয়ার পর কোম্পানিগুলি বন্ড কিনে বিজেপি’কে ২,৪৭১ কোটি টাকা দিয়েছে। এর মধ্যে ১,৬৯৮ কোটি টাকা বিজেপি’কে দেওয়া হয়েছে তল্লাশির পরপরই। আর ১২১ কোটি টাকা তল্লাশির তিন মাসের মধ্যে। ভূষণ আরও তথ্য তুলে ধরে জানিয়েছেন, অন্তত ৪৯টি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বা বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার পরে টাকা নেওয়ার বিনিময়ে বা পোস্ট-পেইড সুবিধা নিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করেছে। তারপর তিন মাসের মধ্যে বন্ডের নামে বিজেপি’র ভাণ্ডারে ৫৮০ কোটি টাকার ঘুষ ঢুকেছে। এই যে ৯৬৬ কোটি টাকার বন্ড কিনে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং বিজেপি’কে দিয়েছে প্রায় ৫৮৫ কোটি টাকা। হায়দরাবাদের এই সংস্থাই ৪৫০০ কোটি টাকার জোজিলা টানেলের বরাত পেয়েছে।
এই প্রসঙ্গেই ভূষণ উল্লেখ করেছেন, গত বছরের ৩ আগস্ট আয়কর হানার তিন মাসের মধ্যে কল্পতরু গোষ্ঠী বিজেপি’কে ৫.৫ কোটি টাকা দিয়েছিল। ২০২৩ সালের ১২ নভেম্বর আয়কর এবং ১ ডিসেম্বর ইডি-র হানার পর তিন মাসের মধ্যে ফিউচার গেমিং বিজেপি-কে ৬০ কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে। 
সাংবাদিক সম্মেলনে অঞ্জলি ভরদ্বাজের কথায়, কর্পোরেট-বিজেপি’র এই আঁতাত এমনভাবে সামনে আসার পর এই বিষয় নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, আমরা তো অবশ্যই অনুসন্ধান করব। তবে নির্বাচনী বন্ডের এই দুর্নীতি পুরো ফাঁস করতে একটি সিট তৈরি হওয়া উচিত। 
সেই তদন্তেরও কতটা সামনে আসবে, এলেও বা কিছু হতে পারে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। খোদ অঞ্জলি ভরদ্বাজের কথাতেও তা উঠে এসেছে। কারণ একজনকে ফাঁসিয়ে আরও কয়েকজন ফাঁসানোর কারবার চলছে। এই যে পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডি রাজসাক্ষীর বয়ানের জোরে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালকে ইডি গ্রেপ্তার করেছে বলে খবর, অরবিন্দ ফার্মা অন্যতম ডিরেক্টর এই ‘রাজসাক্ষী’রেড্ডি বিতর্কিত দিল্লির আবগারি নীতিকাণ্ডে ২০২২-র নভেম্বরে ইডি-র হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পাঁচদিনের মাথায় তার সংস্থা পাঁচ কোটি টাকার বন্ড কেনে। ১৫ নভেম্বর কেনা সেই বন্ড বিজেপি ভাঙায় ২১ তারিখ। গত বছর জুনে সেই রেড্ডিই হয়ে গেল ‘রাজসাক্ষী’। তারপর এই কাণ্ডে গ্রেপ্তার দক্ষিণের কবিতা। এরপর কেজরিওয়াল। 
কোন জালে কাকে জড়ানো চলছে, তার পুরোটা সমানে এলে তো আতঙ্ক ছড়াবেই গেরুয়া শিবিরে!

Comments :0

Login to leave a comment