সৌরভ গোস্বামী
গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিছকই অনুমান নয় বরং বাস্তবে পরিণত হতে চলছে। যদি পরিস্থিতির কিছুই পরিবর্তন না হয়, তাহলে মে মাসের মধ্যে গাজার উত্তর প্রান্তে চরম দুর্ভিক্ষ শুরু হতে পারে। ত্রাণে ইজরায়েলের সেনার বাধা এবং হামলায় এখনই দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি রয়েছে বলে সতর্ক করেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘই।
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশনের (আইপিসি) উদ্যোগে যুক্ত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের অর্ধেকই ভয়াবহ সঙ্কটে।
ইউরোপীয় কমিশনের জয়েন্ট রিসার্চ সেন্টার, অক্সফাম, রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফাও’, বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং সেভ দ্য চিলড্রেন-র মতো ১৯টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে আইপিসি গঠিত। এই গোষ্ঠী বলছে, দুর্ভিক্ষ হলো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সবচেয়ে গুরুতর স্তর, যেখানে জনসংখ্যার কমপক্ষে ২০ শতাংশ বিপন্ন। বিশ্বে প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এবং প্রতি ১০,০০০ মানুষের মধ্যে প্রতিদিন দু’জন মারা যাচ্ছেন সরাসরি অনাহার বা অপুষ্টিজনিত রোগের কারণে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার বর্তমান পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। চিকিৎসা সেবা, জল ও নিকাশির সুযোগও সীমিত হবে। ‘‘পর্যাপ্ত পরিষ্কার জলের উপলব্ধতা জীবন এবং মৃত্যুর সাথে জড়িত বিষয়, এবং গাজার শিশুদের পান করার জন্য এক ফোঁটা জলও দুর্লভ হয়ে পড়ছে’’, ইউনিসেফের পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল ডিসেম্বরে এক্স (পূর্বে টুইটার) এ লিখেছিলেন।
গাজার সঙ্কট জলের সমস্যাকে আরও বাড়িয়েছে। গাজার ভৌগোলিক অবস্থান এই সমস্যার আংশিক কারণ। স্থানীয়দের প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ জল প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে আসে, যা সমুদ্রের খুব কাছাকাছি হওয়ায় লবণাক্ততার মাত্রা বেশি থাকে। ভূগর্ভস্থ জলাধারটি অপরিশোধিত বর্জ্য জলে দূষিত হয়। গাজায় পূর্ববর্তী সংঘাতের ফলে জলের পরিকাঠামোর ক্ষতিও দূষণকে বাড়িয়েছে। ২০১১ সালে, রাষ্ট্রসঙ্ঘই জানায় যে গাজার ৯০ শতাংশেরও বেশি ভূগর্ভস্থ জল পরিশোধন না করে পান করা বিপজ্জনক।
এসব কিছু গাজা উপত্যকায় বসবাসরত স্থানীয়দের পানীয় জলের জন্য ইজরায়েলের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে তুলেছে। গাজায় জল বহনকারী তিনটি পাইপের মধ্যে দুটি অক্টোবরের শেষ নাগাদ পুনরায় চালু করে ইজরায়েল। ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যম ‘টাইমস অব ইজরায়েল’ জানিয়েছে, এর অর্থ প্রতিদিন ২ কোটি ৮৫ লক্ষ লিটার জল পাইপের মাধ্যমে গাজায় প্রবেশ করছে। ৭ অক্টোবরের আগে প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ৯০ লাখ লিটার জল ঢুকত। মানে জল সরবরাহ অর্ধেক হয়েছে।
অন্যদিকে, জ্বালানির অভাবও জল সরবরাহে প্রভাব ফেলেছে। বিদ্যুৎ জেনারেটর এবং গাজার একমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। এই বিদ্যুৎ জলকে লবণমুক্ত করতে এবং জল শোধনাগার চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ জ্বালানির অভাব মানে বিশুদ্ধ জলের অভাব।
অধিকৃত পশ্চিম তীরের জলের পরিস্থিতি কিছুটা কম সমস্যাযুক্ত। কিন্তু এখানেও জের সংকট রয়েছে। মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি পরিচালিত প্ল্যাটফর্ম GlobalWaters.org-এর তথ্য অনুযায়ী, পুরনো পরিকাঠামো ও ক্ষতিগ্রস্ত পাইপের কারণে পশ্চিম তীরে প্রায়ই জল উধাও হয়ে যায়।
পশ্চিম তীরে বসবাসরত মাত্র ৩১ শতাংশ প্যালেস্তিনীয়র পয়ঃপ্রণালীর নিষ্কাশনের সংযোগ রয়েছে এবং সেখানকার বর্জ্য জলের মাত্র ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পরিষ্কার করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে ভূগর্ভস্থ জল আরও দূষিত হচ্ছে।
১৯৯৫ সালে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে স্বাক্ষরিত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটি – যা ‘অসলো ২’ হিসাবে পরিচিত - জল সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার কথা ছিল। দুই পৃথক রাষ্ট্র গড়ে সমাধানের দিকে অগ্রসর না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তিটি কেবল পাঁচ বছরের জন্য স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। যার ফলে ইজরায়েল পশ্চিম তীরের জলের ভান্ডারের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়েছে।
প্যালেস্তিনীয়রা বলছে যে ইজরায়েল তাদের এলাকায় জল নিষিদ্ধ করে কিন্তু ওই এলাকাতেই ইজরায়েলি দখলদারি বসতির জন্য প্রচুর জল পাঠায়। এখানকার বসতিগুলোকে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই অবৈধ বলে মনে করে। যদিও ইজরায়েল, যারা একটি বিশ্ব লবণমুক্তকরণ এবং জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা চালায়, জোর দিয়ে বলেছে যে তারা এই অঞ্চলগুলিতে প্যালেস্তিনীয়দেরও প্রচুর পরিমাণে জল সরবরাহ করছে।
ইজরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বি’সেলেমের ২০২৩ সালের মে মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম তীরে বসবাসরত প্যালেস্তিনীয়রা যে পরিমাণ জল ব্যবহার করে, পশ্চিম তীরে ইজরায়েলিরা তার চেয়ে তিনগুণ বেশি জল ব্যবহার করে। পশ্চিম তীরের জলের ঘাটতির জন্য ‘‘ভাগ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আঞ্চলিক জল সংকটকে দায়ী করা যায় না,’’ রিপোর্ট বলা হয়। ‘‘এটি ইজয়েলের বৈষম্যমূলক নীতির ফলাফল যা ইচ্ছাকৃতভাবে এই জনসংখ্যার মধ্যে একটি কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করে’’।
জল পরিষ্কারভাবে এই এলাকায় একটি রাজনৈতিক ইস্যু এবং গত কয়েক বছরে পশ্চিম তীরে সরবরাহ কমে গেছে। মৃত সাগর বা ‘ডেড সি’-তে জলের স্তর প্রতি বছর গড়ে ১ মিটার করে নেমে যাওয়া প্রমাণ করে যে জলসম্পদের উপর চাপ কতটা বেড়েছে। জল নিয়ে বিরোধ প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল দীর্ঘদিনের বিরোধের অংশ। ভূখণ্ড, পরিচয়, ধর্ম ও সামরিক ইস্যুর পাশাপাশি এই সংঘাতের কয়েকটি প্রধান উপাদানের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
Comments :0