গৌতম রায়
পঞ্চায়েত নির্বাচনের ময়দান থেকে বিজেপি নিজেকে খানিকটা দূরে রাখছে?
কেউ যদি মনে করে থাকেন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নিরিখে এখন পর্যন্ত বামপন্থীদের যে তৎপরতা, বিশেষ করে তৃণমূলের গুন্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, সেই নিরিখে বিজেপি পঞ্চায়েতের এই নির্বাচনী সংগ্রাম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, তাহলে তিনি খুব ভুল ধারণা করবেন।
আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি একটু ঘুরি, একটু ক্ষেত্রসমীক্ষা চালাই, তাহলে প্রায় প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে দেখতে পাবো; বিজেপি যেসব জায়গায় সরাসরি নেই সেখানে ধর্মের আবরণে নানা প্রকারের সংগঠন ,সমাজসেবার মুখোশ পরে সক্রিয়।
আরএসএসের শাখা সংগঠনগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত 'হিন্দু সংহতি',' হিন্দু জাগরণ মঞ্চ' , 'ভারত সেবাশ্রম সংঘ ' সীমান্তবর্তী এলাকা গুলি সহ রাজ্যের যে সমস্ত জেলাগুলিতে ছিন্নমূল মানুষদের আধিক্য রয়েছে, সেখানে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বি্দবেষ ছড়ানোর কাজ করে চলত।
দীর্ঘদিন এই আদলে আরএসএস পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে, গ্রামান্তরে সামাজিক প্রযুক্তি চালিয়েছে। কিন্তু অতি সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সময় থেকেই তারা সরাসরি 'হিন্দু' নামধারী সংগঠনগুলিকে খুব একটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসছে না। বিশেষ করে গত এক-দেড় বছরে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র বামপন্থী রাজনীতি যে পর্যায়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত রেখেছে, তাতে আরএসএসের বিভিন্ন কৌশল বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা, সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পেরেছেন অনেকটাই।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে শহর থেকে গ্রামে নানা ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ক্লাবগুলিকে ব্যবহার করে, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি করে প্রকট তুলতে সক্ষম হয়েছেন, সেই জায়গাটিকেই কিন্তু আরএসএস নানাভাবে ব্যবহার করে , তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে তুলে ধরতে পারছে তুলে ধরছে। আর যেখানে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সরাসরি তুলে ধরবার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতা চ্ছে, সেখানে বিভাজনের রাজনীতিকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলবার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলি বা যে যে অঞ্চলে উদ্বাস্তু মানুষের বসবাস বেশি, সেইসব অঞ্চল গুলিতে নানা ধরনের লৌকিক দেব-দেবীকে কেন্দ্র করে কর্মকাণ্ড এমনভাবে আরএসএস তাদের হাজারো রকমের সংগঠনের ভেতর দিয়ে করে চলেছে, যাতে সীমান্তবর্তী এলাকায় বা উদ্বাস্তু প্রধান এলাকায় সাধারণ মানুষের ভিতরে একদিকে ধর্মের পরিবর্তে ধর্মান্ধতার দিকে ঝোঁক বাড়ে। অপরপক্ষে ওইসব এলাকার সাধারণ মানুষদের মধ্যে সহ নাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পর্কে একটা বিদ্বেষ, বিভাজনের মানসিকতা তীব্র হয়।
বিগত এক-দেড় বছর ব্যাপী বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন গুলি আরএসএসের ভূমিস্তরে কাজ করা বিভিন্ন ধরনের নামী , অনামী সংগঠনগুলি ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। তাই সাধারণ মানুষ হিন্দুধর্ম এবং আরএসএস’র বিদ্বেষমুখী হিন্দুত্বের মধ্যে ফারাক বুঝতে পেরেছে।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের সাথে সাথে, নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডকে, সাধারণ মানুষের উপযোগী করে উপস্থাপিত ক'রে, ধর্ম আর রাজনীতির এক অদ্ভুত মিশেল ঘটিয়ে, সাধারণ মানুষের মননলোকে সাম্প্রদায়িকতাকে গেঁথে দেওয়ার জন্য,নিত্য নতুন কর্মসূচি হল আরএসএসের পশ্চিমবঙ্গে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর নতুন ধারা।
এই ধারা আরএসএস কিন্তু কেবলমাত্র তাদের সংগঠনের আদর্শ গত অবস্থানে থাকা মানুষদের দিয়েই পরিচালিত করছে ,এমনটা ভাবলে ভুল হবে । আরএসএসের মানসিকতায় উজ্জীবিত একটা বড় অংশের মানুষ ,কোথাও প্রত্যক্ষভাবে, কোথাও পরোক্ষভাবে ,তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের সংগঠনের মধ্যে রয়েছে।
এই কর্মসূচি নিয়ে আরএসএসের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হলো; যেকোনো অবস্থাতেই কমিউনিস্টদের প্রতিপত্তিকে খর্ব করা। প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে বিনষ্ট করা। এই লক্ষ্যে আরএসএসের সবথেকে সুবিধাজনক টার্গেট হলো তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন স্তরের বেনিফিশিয়ারি মানুষজন, নানা ধরনের দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে কোথাও সরাসরি আর্থিকভাবে, কোথাও সরাসরি পুলিশ প্রশাসন ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে, তৃণমূলের যে বাহিনী গোটা বাংলা জুড়ে তান্ডব করছে, সেই বাহিনীকে, নানা কৌশলে, নিত্যনতুন সংগঠনের মধ্যে দিয়ে সংগঠিত করে, কমিউনিস্টদের প্রতিহত করবার কাজটি।
এই কার্যক্রমকে সামনে রেখেই আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে আরএসএস ভূমিস্তরে তাদের বিভিন্ন ধরনের সংগঠনকে নিয়োজিত করেছে। আরএসএসের এই নিয়োগ পদ্ধতিতে লোকায়ত ধর্মের বিভিন্ন শাখা, উপ শাখা কে ব্যবহার করে , একটা অদ্ভুত ধরনের সামাজিক বিভাজনের জায়গা কে পশ্চিমবঙ্গের বুকে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে । আরএসএসের যে তাত্ত্বিক অবস্থান , সেখানে কিন্তু লোকায়ত ধর্মের এতটুকু মর্যাদা বা গুরুত্ব নেই । মনুবাদী সংস্কৃতিকেই আরএসএস, ভারতে হিন্দু ধর্মের প্রধান রূপরেখা বলে মনে করে থাকে। সেই রূপরেখাকে রূপায়িত করার মধ্যে দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক, বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্যকেই তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
লোকায়ত সংস্কৃতিতে সচেতন ভাবে বহুত্ববাদী ,সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে সবসময় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেটা সত্যনারায়ণের পূজোই হোক, সেটা বিভিন্ন ধরনের মঙ্গলকাব্যকে অনুসরণ করে বিভিন্ন পূজোর বিষয় হোক, বা একান্ত ভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক ধারাকে অনুসরণ করে লোকায়ত সংস্কৃতির স্ফুরণ হোক, সেই সমস্ত কিছুর ভেতরে কিন্তু গ্রাম বাংলার হিন্দু- মুসলমানের সমন্বয়ী চেতনাকে সব সময় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঠিক এই কারণেই লোকায়ত সংস্কৃতি এবং লোকায়ত ভাবনার পূজার্চনাগুলিকে আরএসএস, তাদের নিজস্ব অভিধান অনুযায়ী ধর্মীয় সংস্কৃতির কখনো অন্তর্গত করে না।
আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে গ্রামবাংলায় সামাজিক বিভাজনের পরিবেশকে আরো শক্তিশালী করবার লক্ষ্যে আরএসএস যে নতুন কৌশল নিয়েছে ,তার একটি বিশেষ দিক হলো, সরাসরি ধর্মীয় নামধাম বাদ রেখে, এমন কিছু সংগঠনের মাধ্যমে তারা এই কাজগুলো সংগঠিত করছে, যে সংগঠনগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে, সাধারণ মানুষ ,সকলেরই মনে হবে সমাজসেবামূলক নানা ধরনের সংগঠন।
বস্তুত ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন করবার লক্ষ্যে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যেভাবে এনজিও রাজ কায়েম হয়েছিল, একই আঙ্গিকে নানা রকমের এনজিও নিত্যনতুন গজিয়ে উঠছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামগুলিতে। সেই এনজিও-গুলি সরাসরি কোনো রাজনীতির কথা বলছে না । এমনকি ধর্মের কথাও বলছে না। কিন্তু তারা নানা ধরনের সামাজিক উন্নয়নের কথা বলছে। সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তারা কাজ করবার কথা বলছে। স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করবার কথা বলছে শিক্ষা নিয়ে কাজ করার কথা বলছে। সমস্ত কাজের মধ্যেই কিন্তু একটা সূক্ষ্ম সামাজিক বিভাজনের আঙ্গিক কে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ,যার ফলশ্রুতি হিসেবে মানুষ আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে কোনো অবস্থাতেই যাতে ধর্মনিরপেক্ষ শিবির, গণতান্ত্রিক শিবিরের প্রতি আকৃষ্ট না হয়।
যেখানে যেখানে বিজেপি শক্তিশালী ,সেখানে বিজেপির পক্ষে সাওয়াল করা হচ্ছে। আর যেখানে বিজেপির ততটা রাজনৈতিক বিস্তার নেই ,সেখানে বিজেপির লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে ,অর্থাৎ; কমিউনিস্টদের যাতে প্রতিহত করতে পারা যায়, বা কমিউনিস্টদের সঙ্গে যে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল শক্তি, এক সঙ্গে নির্বাচনী সংগ্রামে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদেরকে যাতে প্রতিহত করতে পারা যায়, সেই লক্ষ্যে এই সমস্ত তথাকথিত সমাজসেবী সংগঠন এবং কিছু কিছু ধর্মীয় আবরণে আবৃত সংগঠনগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আরএসএসের এই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এই মুহূর্তে গোটা পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভয়ংকর রকম ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই সংগঠনগুলিকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে সঙ্ঘের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত অর্থ পশ্চিমবঙ্গের বুকে ছড়ানো হচ্ছে।
গ্রাফিক্স: মনীষ দেব
Comments :0