Kalighater kaku

সঙ্ঘ পরিবার থেকেই মমতা-পরিবারে কাকু

রাজ্য

২০০৯। জঙ্গলমহল জুড়ে তখন মমতা ব্যানার্জি-শুভেন্দু অধিকারিদের নৈরাজ্যের আন্দোলন চলছে, প্রতিদিন খুন হচ্ছেন সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থক। 
  ঠিক সেই সময়তেই তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেদ মারোয়া বলেছিলেন, ‘তৃণমূলে মাওবাদী অনুপ্রবেশ শুরু হয়ে গেছে’!
  দীর্ঘ সময় পেরিয়েছে। নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’ নামের চরিত্রই সাক্ষী, তৃণমূলের আরএসএস’র অনুপ্রবেশও অনেক আগেই শুরু হয়েছে।
  মমতা ব্যানার্জির পরিবারের অন্দরমহলের লোক, ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি যেমন তাঁর ‘সাহেব’ তেমনই অভিষেক ব্যানার্জির বাবা অমিত ব্যানার্জি কালীঘাটের কাকু ওরফে সান্টুদার ‘বন্ধু’ বলেই জানে গোটা পটুয়াপাড়া। সেই অন্দরমহলের ব্যক্তিই তৃণমূলের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের সঙ্ঘ পরিবারেরও কর্মী!
  আটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চুটিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ করেছেন এই কালীঘাটের কাকু। তাঁর দুই দাদাও আরএসএস’র সঙ্গেই যুক্ত। কালীঘাটের কাকু আরএসএস-কে নিছক ‘সামাজিক দায়িত্বশীল’ সংগঠন বলেই মনে করেন। তাঁর বড় দাদা সঙ্ঘের সর্বক্ষণের কর্মী।
  সঙ্ঘ পরিবারের সরাসরি সংশ্রবে থাকা কালীঘাটের কাকু কীভাবে মমতা ব্যানার্জির পরিবারের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন, কীভাবে অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সন্দেহজনক সংস্থার ডিরেক্টর বনে গেলে তা রীতিমত রহস্যময়। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকারে আসার পরে ভবানীপুরে উপনির্বাচন হয়। ততদিনে মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে ফেলেছেন। ১১’র ভোটে তিনি প্রার্থী ছিলেন না। তাই উপনির্বাচন হয় ভবানীপুরে। মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই তৃণমূলের প্রার্থী আর সেই ভোটে তৃণমূলের ‘ডামি ক্যান্ডিডেট’ হয়েছিলেন আদ্যোপান্ত আরএসএস’র সংশ্রবে বেড়ে ওঠা সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। 
  এমনকি নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁর নাম সামনে আসার পরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথোপকথনের সময়তেই কালীঘাটের কাকু অবলীলায় বলেছিলেন, তাঁদের বাড়িতে আরএসএস নেতারা আসতেন! 
সেই কালীঘাটের কাকু গ্রেপ্তার হওয়ার পরে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেন তাঁর দাদা অজয়কৃষ্ণ ভদ্র। নিজেকে সক্রিয় আরএসএস’র লোক বলে দাবি করে অজয়কৃষ্ণ ভদ্র বলেন, ‘সান্টুর (কালীঘাটের কাকু এই পারিবারিক নামেই পাড়ায় পরিচিত) সঙ্গে আমার সেভাবে যোগ নেই। একটা সামান্য ব্যাপারে ফারাক হয়েছিল। তবে ও নিজেও দীর্ঘদিন আরএসএস’র সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে তৃণমূল করে। আমরা জানতাম ও অভিষেক ব্যানার্জির অফিসে চাকরি করে। অভিষেক ব্যানার্জিও কয়েকবার এসেছিলেন বাড়িতে, আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমি ওঁর দাদা এই বলেই জাস্ট পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি এসবের মধ্যে থাকি না। আমি আরএসএস করি, কোনও পার্টি করি না’।
  সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রের বড় দাদা অমর কৃষ্ণ ভদ্রের একটি ফ্ল্যাটও নিয়ে নিয়েছেন সুজয় ভদ্র। তা জানিয়েই মেজ দাদা অজয়কৃষ্ণ ভদ্র বলেন, ‘বড় দাদার সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ নেই। আসলে উনি তো আরএসএস’র হোলটাইমার। কখন কোথায় থাকেন!’ তাঁর গোটা পরিবারই যে আরএসএস’র ভাবধারা ও কর্মধারায় বিশ্বাসী তা স্পষ্ট করেই জানান অজয়কৃষ্ণ ভদ্র। তবে ভাই সুজয় ভদ্র আগে দীর্ঘদিন আরএসএস করলেও এখন তৃণমূলই করেন। তাছাড়া এলাকায় প্রোমোটিং ব্যবসাতেও সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র বেশ নাম করেছিল বলে দাবি তাঁর। এলাকার লোক নাকি ইদানীং তাঁর কাছে ‘যেচে’ জমি দিত প্রোমোটিংয়ের জন্য। লোকজন নাকি খুঁজতো সান্টুকে। তবে এখন তাঁর বদনাম হয়ে গেছে বলেও অকপটে জানালেন কালীঘাটের কাকুর দাদা। একইসঙ্গে অন্যায় করলে শাস্তি হোক, তাও বলেন তিনি।
  পরিবারের তিন ভাই-ই আরএসএস। দুই দাদা এখনও সক্রিয় আরএসএস-এ। সঙ্ঘের অনেক বড় মাথাদেরও আনাগোনা ছিল তাঁর বাড়িতে। সেই সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রই অভিষেক ব্যানার্জির ব্যবসায়িক অংশীদার, মমতা ব্যানার্জির ভোটে তৃণমূলের ডামি ক্যান্ডিডেটও হন। অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র ডিরেক্টর বনে গিয়েছিলেন। দু’বছরের বেশি সময় ধরে ডিরেক্টর ছিলেন। ২০১২ সালে ১৯ এপ্রিল বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের অন্যতম সদস্য হিসাবেই যোগ দেন এই সুজয় ভদ্র। অভিষেক ব্যানার্জিও ছিলেন এই বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্য। যদিও অভিষেক ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে বোর্ড অব ডিরেক্টর্স থেকে পদত্যাগ করেন। 
 এই আরএসএস যোগের কারণেই কি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন কালীঘাটের কাকু যে সংবাদমাধ্যমের সামনেই বলেছিলেন, ‘আমার সাহেব অর্থাৎ অভিষেক ব্যানার্জিকে ছোঁয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর কারো নেই।’
  শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, গত ২০ তারিখে তাঁর বাড়ি, ফ্ল্যাটে দীর্ঘ তল্লাশি অভিযানের সময়তেও তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের দিকে আঙুল তুলেই কালীঘাটের কাকু বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে যা পারেন করুন, কিন্তু সাহেবের কিছু করতে পারবেন না আপনারা!’
  ইডি’র তরফে এদিন জানানো হয়, মঙ্গলবার রাত ১০-৪৫ মিনিট নাগাদ তদন্তে চরম অসহযোগিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর থেকেই তিনি খাবার মুখে তুলছেন না। এদিনও সকালে কিছু খাননি। আদালতে সেকথা জানিয়েই ইডি’র তরফে আইনজীবী বিচারককের উদ্দেশ্যে বলেন উনি কিছু না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ইডির আধিকারিকেরা মনে করছেন, সে ক্ষেত্রে জেরা এড়িয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ থাকবে তাঁর কাছে। জেরা এড়ানোর কৌশল এটা, ফলে তদন্তও ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ইডি’র আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি।

Comments :0

Login to leave a comment