Kamduni

কামদুনি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন সরকারের ভূমিকায়

রাজ্য

কামদুনি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চের রায়ের পর পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ এবং সরকারি আইনজীবীদের পেশাদারি দক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে গেছে। যে পুলিশবাহিনী একসময়ে ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ধর্ষণ করে খুনের অপরাধ প্রমাণ করে ফাঁসির সাজা কার্যকর করাতে পেরেছিল, কামদুনির তরুণীকে নৃশংসভাবে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় তারা আদালত থেকে তেমন কোনও সাজা তো নিয়ে আসতে পারলই না, বরং ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত একজন সহ চারজন মুক্তি পেয়ে গেল! আঙুল শুধু পুলিশের ব্যর্থতার দিকেই উঠছে না সরকারি আইনজীবী এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর দিকেও উঠছে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিই কামদুনির ঘটনার দশ দিনের মাথায় ঐ গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের হুমকি দিয়ে এসেছিলেন।
তখন সবে একবছর হলো তৃণমূল সরকার এসেছে। ২০১৩ সালের ৭ জুন রাতে কামদুনিতে উদ্ধার হয় কলেজ পড়ুয়া তরুণীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। দিল্লিতে নির্ভয়াকাণ্ডে তখনও উত্তপ্ত সারা দেশ, কামদুনির ঘটনায় কালিমালিপ্ত হলো বাংলাও। ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত আনসার আলিকে গ্রামবাসীরা ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, পুলিশ তাকে জেরা করে ধরে বাকিদের। কামদুনির মানুষের প্রতিবাদ ও রোষ ঠেকাতে নামানো হয় পুলিশ এবং র্যা ফের বিরাট বাহিনী। খুনি ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। ১৭ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কামদুনিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেদিনই তিনি নিহত তরুণীর দুই বন্ধু টুম্পা কয়াল এবং মৌসুমী কয়ালকে হুমকি দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আতঙ্কে ছিলেন কামদুনিবাসী, আশঙ্কায় ছিলেন দোষীদের আদৌ শাস্তি হবে কিনা। 
২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি নিম্ন আদালতের বিচারক সঞ্চিতা সরকার কামদুনির তরুণীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে খুনের অপরাধে ধৃতদের তিনজনের ফাঁসি ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল। তিন বছরের মধ্যে দোষীদের শাস্তি হয়ে গেছে বলে তৃণমূল নেতারা তখন মমতা ব্যানার্জির প্রশাসনের কৃতিত্বও দাবি করেছিলেন। কিন্তু সাজাপ্রাপ্তরা স্বাভাবিকভাবেই হাইকোর্টে আপিল করে এবং গত শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং অজয়কুমার গুপ্তের ডিভিসন বেঞ্চ ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত তিনজনের একজন সহ চারজনকে মুক্তি দিয়েছে এবং বাকি দুইজনের ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে। এরপরেই কামদুনিতে আবার বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছে।
আদালত রায় দিয়েছে সিআইডি তদন্তের সাক্ষ্য, প্রমাণ এবং সরকারি আইনজীবীদের সওয়ালের ভিত্তিতে। তাই আঙুল উঠেছে পুলিশি তদন্ত এবং সরকারি আইনজীবীদের দিকেই। আইনজীবী মহলেরই অভিযোগ, একটি মামলায় যদি ১৬ বার সরকারি আইনজীবী বদল হয়, তাহলে পরিণতি এছাড়া আর কী হতে পারে? যে রাজ্য সরকার দুর্নীতি মামলার হাত থেকে বাঁচতে, এমনকি তদন্ত এড়াতে সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশের সবচেয়ে নামকরা আইনজীবীদের হাইকোর্টে এবং সুপ্রিম কোর্টে নিযুক্ত করতে পারে, তারাই কেন অদক্ষ আইনজীবীদের নিয়োগ করেছিল কামদুনি মামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাতে? ধর্ষণ করে খুনের অপরাধ দমনে এটাই সরকারের মনোভাব? 
গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে সিআইডি তদন্ত নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রীর মান রাখতে তারা কি তড়িঘড়ি করে এমন ফাঁকফোকর সমেত চার্জশিট তৈরি করেছিল যাতে নিম্ন আদালতে শাস্তির ঘোষণা হয়ে গেলেও হাইকোর্টে গিয়ে আটকে যেতে পারে? 
সমালোচকদের বক্তব্য বাদ দিয়ে যদি হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চের রায় খতিয়ে দেখা যায় তাহলে তার মধ্যেই বহুবার উল্লেখিত রয়েছে তদন্তকারী সংস্থার প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থতার কথা। সেই সময়ে দিল্লিতে নির্ভয়াকাণ্ডে খুনি ধর্ষণকারীদের নৃশংসতার কথা বিচারপতিরা উল্লেখ করেছিলেন ফাঁসির সাজা দেওয়ার অন্যতম যুক্তি হিসাবে। কামদুনির ঘটনাতেও সেই নৃশংসতার অভিযোগই করেছিলেন নিহত তরুণীর পরিবার। উদ্ধার করা মৃতদেহ দেখে শিউরে উঠেছিল গোটা গ্রাম। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ কী বলেছে ? ৯২ পৃষ্ঠার রায়ের ৮৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘এক্ষেত্রে আদালতে যে মেডিক্যাল রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে তাতে বর্বরতা সেই তুলনীয় নয়। ডাক্তারের অভিমতে দেখা যাচ্ছে যে জোর করে ধর্ষণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, এই রিপোর্টে নিহতের ভ্যাজাইনা, অ্যাবডোমেন এবং পেলভিক অংশে ক্ষতের গভীরতার উল্লেখ নেই।’
যে কোনও খুনের ঘটনায়, বিশেষত ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় মেডিক্যাল রিপোর্টের গুরুত্ব পুলিশের কনস্টেবলরাও জানেন, সিআইডি’র আধিকারিকরা জানেন না? 
কেবলমাত্র কিছু সাক্ষ্য বয়ান আদালতে হাজির করেছিল পুলিশ, আনুষঙ্গিক প্রমাণ দাখিল করেনি। একথাও বলা হয়েছে হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চের রায়ে। রায়ে বলা হয়েছে, ‘অপরাধের পূর্বে চক্রান্তের প্রমাণ দাখিলে পুলিশের তদন্ত ব্যর্থ হয়েছে। তদন্তকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এগতে হয়, কেবল একজন অভিযুক্তের বয়ানের ভিত্তিতে আরেকজনের সংযোগ টেনে আনা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।’ এরই সঙ্গে ‘আনসারের মতো ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে অপরাধে অংশগ্রহণের কোনও প্রমাণ আমিন আলির বিরুদ্ধে প্রদর্শিত হয়নি’ —এই কারণ দেখিয়ে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আমিন আলিকে মুক্তি দিয়েছে হাইকোর্ট। 
কামদুনির মতো হেভিওয়েট মামলায় রাজ্যের সবচেয়ে ‘দক্ষ’ তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি’র তদন্ত শেষপর্যন্ত এমন অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে? 
আদালতের রায় শোনার পরে কামদুনি সহ সারা রাজ্যের মহিলা আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তৃণমূল নেতারা বল ঠেলে দিচ্ছেন কোর্টরুমের দিকে। ৯২ পৃষ্ঠার রায়ে তদন্তকারী পুলিশ এবং সরকারি আইনজীবীদের অদক্ষতা যেভাবে বেআব্রু হয়ে গিয়েছে সেকথা তাঁরা উচ্চারণও করছেন না। 
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক কনীনিকা ঘোষ অবশ্য সোজাসুজি অভিযোগ করেছেন, তৃণমূল পুলিশের সাহায্যে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছে বলেই আদালতে দোষীদের শাস্তি হয়নি। আর সংগঠনের সর্বভারতীয় নেত্রী মালিনী ভট্টাচার্য বলেছেন, সাক্ষ্য প্রমাণ তো পুলিশের জোগাড় করার কথা, তারা সেই দায়িত্ব পালন না করলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার পক্ষে বড় বিপদ। হাথরসে যা হয়েছে, বিলকিস বানোর ঘটনায় অপরাধীরা যেভাবে ছাড় পেয়েছে, এরাজ্যেও কি তার প্রতিফলন হচ্ছে? কেন্দ্রের শাসকদলের মতোই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলছে রাজ্যের শাসকদল? তাহলে সেটা ভয়ানক বিপজ্জনক ঘটনা।

Comments :0

Login to leave a comment