MUKTADHARA | PROBANDHAYA — EID | SOURAV DUTTA — 10 APRIL 2024

মুক্তধারা | প্রবন্ধ — 'ঈদ্ মোবারক'-- ধ্বনির মধ্যেও অনুরণিত হয় 'আদাব'--এর অন্তহীন বিচ্ছেদের সুর | সৌরভ দত্ত | ১০ এপ্রিল ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA  PROBANDHAYA  EID  SOURAV DUTTA  10 APRIL 2024

মুক্তধারা  

প্রবন্ধ

'ঈদ্ মোবারক'-- ধ্বনির মধ্যেও অনুরণিত হয় 'আদাব'--এর অন্তহীন বিচ্ছেদের সুর

সৌ র ভ  দ ত্ত

ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও ঈদ উৎসবের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল সমরেশ বসুর 'আদাব' গল্পটি।একদিকে বুড়িগঙ্গার পাড়ের সুইবডার মাঝি ও অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার সুতাকলের শ্রমিক কর্মীর মর্মান্তিক জীবনের ইতিবৃত্ত গল্পটি।ভারতবর্ষের বুকে ত‍ৎকালীন সময়ে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ রোপিত হয়েছিল তার মধ্যেই নিহিত ছিল এই হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্র।মৃত্যুর জমাট দাগ,রক্তক্ষত চিহ্ন,গোলাবর্ষণকে তুলে ধরা হয়েছে আখ্যানটিতে।ঘটনাপ্রবাহে এসেছে ইসলামপুর ফাঁড়ি,বাদামতলির ঘাটের কথা।মুসলমান মাঝি ও সুতাকলের শ্রমিক কিছুক্ষণের জন্য হলেও সমস্ত ভয়-ভীতি-সন্দেহ কাটিয়ে পরস্পর বন্ধু হয়ে মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল।গল্পের শেষাংশে বিদায় মুহূর্তে মাঝির আদাব সম্ভাষণ বড় ব্যথাতুর হয়ে ওঠে।নাওয়ের মাঝির বুকে একরাশ স্বপ্ন ছিল–ঈদের পরবে বাড়ি যাবে,পোলামাইয়ার জন্য নিয়ে যাবে খুশির উপহার।ভিজে দেশলাই জ্বালানোর মুহূর্তে জানা যায়–তাদের কার ধর্ম কি।সুইবডার মাঝির পুঁটুলিতে থাকা ঈদের পোষাককে সন্দেহের চোখে দেখেছে সুতাকলের মজুর।অন্যদিকে দাঙ্গায় সুতামজুরের ভগ্নিপতি খুন হয়।ঠিক একইভাবে বাদামতলির ঘাটে মাঝির নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছিল দাঙ্গাসন্ত্রস্ত মানুষ।গল্পের একদম শেষে দাঙ্গার ভয়াবহ রেশটুকু নিয়ে সুতামজুর নিঃস্পন্দ,নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে।দেখতে পায় মাঝির পোশাক রক্তে রাঙা।চিরবিদায়ের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে ভয়ংকর ট্র্যাজেডি।এই ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড চলতেই থাকে।কোনদিন শেষ হয় না।ধর্মযুদ্ধই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে।যদিও ঈদ কিন্তু ইসলামিক সংস্কৃতিতে এক পবিত্র উৎসব।দ্বিতীয় হিজরি সাল অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈদ্-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহা উৎসবের সূচনা।ঈদ্ শব্দটি এসেছে প্রাচীন আরামি ভাষা থেকে।যদিও ঈদ্ শব্দের অর্থও উৎসব।ঈদ মূলত পালিত হয় একমাস রোজার উপবাস থাকার পর শওয়াল মাসের এক তারিখ।ঈদের আগের সন্ধ্যায় আকাশে উঁকি দেয় সাদা কাস্তের মতো আধখানা চাঁদ।রমজিনকে বাদ দিয়ে ঈদ্-উল-ফিতর ভাবা সম্ভব নয়।উপবাসের ত্যাগ-তিতীক্ষা-কৃচ্ছ্রতার মধ্যে জুড়ে আছে ঈদ্ শব্দের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ।ফিতর শব্দটির অর্থ–দান।ঈদ উৎসবে মুখর ইসলামিক সংস্কৃতির মানুষজন নতুন জামা-কাপড়,খাদ্যদান প্রভৃতির মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধব,স্বজন,প্রতিবেশিদের মধ্যে এটি একটি আনন্দের দিন।আজও তাই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভুলে একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ।ঈদ উৎসব বয়ে আনে শান্তির বার্তা।ঈদগাহে নামাজে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ।নামাজ শেষে হয় পরস্পর মধুর আলিঙ্গন।নামাজের পরে সংলগ্ন গোরস্থানে পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্য প্রার্থনা করা হয়।নারী ও শিশুরা সজ্জিত হয় রঙবেরঙের পোশাকে।টানা টানা চোখে কালো সুরমা আর হাতে মেহেন্দির রেখা।মহল্লায় ঘুরতে থাকে আতরের খুশবু।ইসলামিক সংস্কৃতিতে নামাজ শেষে মুরুব্বি স্থানীয় মানুষদের শ্রদ্ধাবনত হয়ে সালাম জানানো এবং অন্যান্য প্রতিবেশি ও স্বজনবন্ধুদের ঈদ মোবারক জানানোর রীতি আজও রয়ে গেছে।এ উৎসবে অনেক সংখ্যালঘু পরিবারে একাত্ম হয়ে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন ভিনধর্মের মানুষ।অতিথিদের পরম্পরা মেনে সিমুই,লাপচা,হালিম,হালুয়া,সরবত প্রভৃতি খেতে দেওয়া হয়।তবু আজও ঈদের দিন এলে চোখের জলে ভেসে যান– আনিস খানের আব্বুজান।'আদাব'-- গল্পের মতোই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরেও উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে শাস্তি পায় না দুর্বৃত্তরা।প্রশ্ন ওঠে তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে। কালচক্রযানে বছর পেরিয়ে যায় ঈদ আসে ঈদ যায় সুবিচারের অপেক্ষায় থাকে আনিস খানের সর্বংসহা পরিবার।

"যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—
আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এণ্টালীর—’
কোথাকার কেবা জানে; "--(জীবনানন্দ দাশ)

Comments :0

Login to leave a comment