সৌরভ গোস্বামী
স্বাধীনতা ও দেশভাগ পরবর্তী ভারতে আবর্তিত হয়েছে দু’টি ভাবনা। একটি ভাবনা ছিল, যখন ধর্মের নামেই দেশ ভাগ হয়েছে, ইসলামের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে ভারতেও হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। উলটোদিকে ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী, সাধারণতান্ত্রিক ভারত তৈরির ভাবনা। যা ছিল কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের ভাবনা। এই আদর্শগুলি তাঁরা ভারতের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছর থেকে ‘অমৃতকাল’’ উদযাপন চলছে কেন্দ্রের সরকারে আসীন বিজেপির উদ্যোগে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ বনাম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মতাদর্শগত সংঘাত এখনও শেষ হয়নি। বরং ২০১৪ সালে কেন্দ্রে আরএসএস’র নিয়ন্ত্রণে চালিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে তা ক্রমশ তীব্রতর হয়েছে। মোদী জমানায় বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে সঙ্ঘ পরিবারের প্রত্যক্ষ মদতে নতুন করে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি জোরদার হয়েছে। বস্তুত সরকারি অনুষ্ঠানে দেখানোর চেষ্টা চলছে যে হিন্দুরাষ্ট্র হয়েই গিয়েছে।
এ কথা কারও অজানা নয় আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদীরা সংবিধান এবং ভারতের জাতীয় পতাকাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। স্বাধীনতা আন্দোলনকে পেছন থেকে ছুরি মারতেও কসুর করেনি। তাদের উদ্দেশ্য ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই সংবিধানের অপরিহার্য তিনটি স্তম্ভ- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্র- সেগুলিকে ধ্বংস করে এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা, যা পৃথিবীর যে কোনও দক্ষিণপন্থী শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কোনও দক্ষিণপন্থী শাসকই বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা অনুমোদন করে না।
বিজেপি’র আশু লক্ষ্য হল তাদের শাসন ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দিতে দেশব্যাপী একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিষাক্ত মনোভাব তৈরি করা।
এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হল অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে একটি ট্রাস্টকে সেটা নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা সত্ত্বেও হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনুসারে সাংবিধানিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজে মহাযাজকের ভূমিকা নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেন। যাতে দেখানোর চেষ্টা হয় যে ভারত ইতিমধ্যেই একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। একইভাবে, নতুন সংসদ ভবনে সেঙ্গোল এবং জাতীয় প্রতীক স্থাপনের সঙ্গে হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের মানসিকতাকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা।
সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনও পরোক্ষে হিন্দুত্ববাদের প্রচারে ব্যবহার করা হয়। ঘোষণা করে যে জি-২০ সভাপতিত্ব সর্বজনীন একত্ববোধের (Universal Uniformiy) প্রচারে কাজ করবে। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-র আধিপত্যবাদী অর্থ করা হলো। একত্ব নয়, এই ধারণার মূলে রয়েছে বহুত্ব এবং বৈচিত্র্যের উদযাপন, তাকে আড়াল করা হলো।
একইভাবে, নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের জন্য সেঙ্গোলের ঐতিহ্যকে টেনে আনা হলো ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। সেঙ্গোল আসলে মধ্যযুগে রাজা ও সম্রাটদের মতো মোদীকে 'শাসন করার ‘ঐশ্বরিক অধিকার' প্রদানের’ বার্তা দিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মূলেই ছিল হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের রীতিতে রাজ্যাভিষেক। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দেশের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নয়, একজন রাজার রাজ্যাভিষেক হচ্ছে, পরোক্ষে এই বার্তাই দেওয়া হল।
মোদি যে নতুন ভারতের কথা বলছেন, সেটি হলো এমন একটি ভারত যা দ্বারা পরিচালিত হবে 'রাজা' এবং 'প্রজা' নীতির ভিত্তিতে। বাদ থাকবে অধিকার, সংবিধান যা আমাদের দিয়েছে। বস্তুত আধুনিক গণতন্ত্রে সেঙ্গোলের কোনো স্থান থাকতে পারে না। শাসক/রাজা খোদ ঈশ্বরের দূত তাই তাঁর বিরোধিতা করা যাবে না। তা করার অর্থ দেশের/রাজ্যের বিরোধিতা বা রাজদ্রোহ/দেশদ্রোহ। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে রাজতন্ত্রকে স্থায়িত্ব দেওয়া হয় থমাস অ্যাকুনাসের theory of divine origin এবং জার্মান দার্শনিক হেগেলের লেখাপত্রেও রাষ্ট্রের এই ব্যাখ্যা ধরা পড়ে।
আবার, সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমর্থকদের মধ্যে ব্রিটিশ দার্শনিক থমাস হবসের লেখাতেও (শাসকের ঐশ্বরিক ক্ষমতার কথা ব্যতিরেকে) ঘুরিয়ে রাজতন্ত্রের-রাজার-প্রজার সম্পর্কের ‘উপযোগিতার’ কথা দেখা যায়। নতুন সংসদ ভবনে সেঙ্গোল আমদানির কারণ ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতীক বলে বকলমে ঘোষণা করা,, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
একটি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল রাষ্ট্র এবং এর নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক, যেখানে জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। রাষ্ট্র জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। সংসদের নতুন ভবনের পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি গণতান্ত্রিক, রাষ্ট্র-নাগরিক সমীকরণকে ধ্বংস করে একটি সামন্তবাদী রাজা-প্রজা সমীকরণের ইঙ্গিতবাহী।
যদিও, শ্রমিক এবং কৃষকদের নেতৃত্বে জনগণের একটি বড় অংশ বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক নীতির পাশাপাশি হিংসাত্মক সাম্প্রদায়িক আদর্শ- উভয়ের বিরুদ্ধে একজোটে লড়াই করে মোকাবিলা করছে। সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ডাকে একাধিক সর্বভারতীয় ধর্মঘট, তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের দীর্ঘ সংগ্রাম, দলিত ও আদিবাসীদের প্রতি নৃশংসতা ও বৈষম্যের শাস্তি দেয় এমন আইন বহাল রাখার সংগ্রাম, উন্নত কাজের পরিবেশের জন্য মহিলা প্রকল্প কর্মীদের সংগ্রাম, লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শ্রমিকদের সংগ্রাম, সবই মোদীর এই রাজা-প্রজা শাসনকে ঘিরে প্রতিরোধের অংশ।
হিন্দুরাষ্ট্র দেখিয়ে অবাধ শোষণ চলছে। প্রাকৃতিক সম্পদ লুট হচ্ছে, ধনীদের বিপুল কর ছাড় দিচ্ছে ব্যাঙ্ক। আরেকদিকে দামের বোঝা, চড়া বেকারির হারে নাজেহাল জনতা। ফলে লড়াই চলবে।
Comments :0