অন্যকথা
বনমহোৎহসব পালন অরণ্যকে রক্ষা করার দৃঢ় অঙ্গীকার
সৌরভ দত্ত
নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আজ নাহি রে…--আষাঢ়ের নিরবিচ্ছিন্ন বারিধারা। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি।ভেক রব।ভেজা মাঠে গোরু নিয়ে চলেছে রাখাল। ঝুমকোলতা চুঁইয়ে নামছে বৃষ্টির ফোঁটা।কচু পাতা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছে নবীন কিশোর।এ দৃশ্য কি সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছে…ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যাত্রা আর কতদিন। মানবসভ্যতা কি শেষ হতে চলেছে। স্টেমসেল থেকে কি জন্ম নেবে ডাইনোসর!ফিরে আসতে চলেছে আর এক জুরাসিক যুগ।লাইভ দেখব আমরা!এক অস্তিত্বহীন অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্নগুলোর কানা ঘুসো শোনা যায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও দূষণ কমাতে বনমহোৎহসব আসে বনমহোৎহসব যায়। উন্নয়ন আর পুঁজির বাজারে বঙ্গে ১৪–২০ জুলাই সরকারি স্তরে বনমহোৎহসব পালনের ঘোষিত নির্ঘণ্ট। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, প্রাতিষ্ঠানিক দপ্তরে ঘটা করে পালিত হয় বনমহোৎহসব বা অরণ্য সপ্তাহ। কিন্তু পরিবেশবিদরা প্রশ্ন তুলছেন– একদিক থেকে গাছ লাগানো হয় বিভিন্ন পরিবেশ ও প্রকৃতিপ্রেমী সেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলির উদ্যোগে। নাগরিক বনসৃজন,গাছদত্তকীকরণ,হাউজিৎ কমপ্লেক্স এ গাছ প্রদান। ভ্রাম্যমাণ গাছ প্রদান প্রকল্প। পরিবেশ সুরক্ষার নিয়মনীতি না মেনে অন্যদিকে খাল-বিল-নদী সংস্কার এর নামে কেটে নেওয়া হয় গাছের মূল-কাণ্ড-পাতা। বহু বনভূমি নষ্ট হয় এভাবেই।জলাভূমি ধ্বংস করে মাথা তোলে ফ্ল্যাটবাড়ি। বন্যজীবজন্ত বাসস্থান হারিয়ে চলে আসে ঘর-গেরস্থে-রাস্তায়। রাস্তা পারাপার করতে গিয়ে রক্তাক্ত হয় ,প্রাণ হারায়–হনুমান,বেঁজি, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল,সাপ,গোসাপ। উপযুক্ত গাছপালা না থাকায় ফলমূল না থাকায় হনুমান ও মানুষের দ্বৈরথ তৈরি হয়। বিভিন্ন মিটিং, মিছিলে স্লোগান ওঠে–দাও ফিরে সে অরণ্য… --অথচ প্রাচীন মানবেতর সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গাছকে আমরা দিনের পর দিন কেটে ফেলি। চারিদিকে করাত কলের বাড়বাড়ন্ত। সেদিকে কারো নজর থাকে না। বনমহোৎহসব পালনের মুহূর্তে সবাই গাছ বসিয়ে প্রশাসনিক দপ্তরের কেষ্ট-বিষ্টুদের সাথে সেলফি বা ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকেন। সেখানে কমল চক্রবর্তীরা গাছেদের গ্রাম–ভালোপাহাড় তৈরি করেন নিভৃতে। পুরুলিয়ার দুখু মাঝিরা সাইকেলে গাছের পসরা নিয়ে বের হন।গাছ পোঁতেন। সন্তানগাছ। মাতৃরূপা অরণ্যাণী। আগামীর ছায়া।যেখানে পথিক ঘুমিয়ে পড়বে কিছুক্ষণ।শালপাতায়,পদ্মপাতায়, কলাপাতায় বনভোজন হবে।সুকান্তের লাইন মনে পড়ে–চ’লে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল… এইসব প্রবাদপ্রতিম মানুষগুলো পরিবেশ বাঁচাতে সামাজিক বন সৃজন করেন নিরবে নিভৃতে। কিন্তু দুঃখের কথা এ রাজ্যেই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিয়োজিত অধ্যাপক চরম নিগৃহীত হন দুষ্কৃতীরদের দ্বারা।দুঃখে ছেড়ে দিতে চান পেশাগত বৃত্তি।একটা দূষিত পৃথিবীর করাল ছায়া ফুটে ওঠে। একদিকে বৃক্ষরোপণ,অন্যদিকে বৃক্ষনিধন যজ্ঞ।বনমহোৎহসব চলাকালীন ও গাছ কাটার রমরমা চলে।কান পাতলেই শোনা যায় ইলেকট্রিক করাতের কর্কশ ধ্বনি। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে গাছ মানব। শীতকালে মানুষ্যসৃষ্ট দাবানলে ধ্বংস হয়ে যায় কয়েকশো হেক্টর বনভূমি।গাছ লাগানোর কথা বলা হয় সোচ্চার কন্ঠে। সচেতন বাণী বর্ষিত হয় না—গাছ কাটবেন না। প্রাচীন বা হেরিটেজ বৃক্ষগুলো এভাবেই ধ্বংসের পথে।বট, অশ্বত্থ,নিচ,তাল,খেঁজুর,জাম ,গাব
,আঁশফল,লিচু,পেয়ারা,ফলসা,টক করমচা,ডেঁপর প্রভৃতি গাছ কমে যাচ্ছে ক্রমশ। চরকশুশ্রুত সংহিতায় বর্ণিত রয়েছে ভারতে প্রাপ্ত বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ এর গুণাগুণ কবিতার শিশুটা মায়াবী কন্ঠে আবার কবে বলে উঠবে –কাঠবেড়ালি কাঠবেড়ালি পেয়ারা তুমি খাও?…বনমহোৎহসব এ যে পরিমাণ গাছ লাগানো হয় তা প্রতিরক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অপ্রতুল।ফলত গাছ বাঁচার হার খুব কম। এবারের বনমহোৎহসব এর থিম ‘এক পেড় মা কে নাম’ বলে যতই গালভাষণ দেওয়া হোক না কেন তথ্য বলছে অন্য কথা। অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে ভারতে। অতিরিক্ত লবণাম্বু উদ্ভিদ বা ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের ফলে উষ্ণায়নের থাবায় জলের নিচে চলে গেছে বসেছে সুন্দরবন এর নিউমুড়া,লোহাচড়ার মতো দ্বীপাঞ্চল। কলকাতার শহরাঞ্চলে বহুতলের ফাটলগুলিও অশনিসংকেতের হাতছানি। বারবার ভূমিকম্প, বজ্রপাত তার প্রমাণ স্বরূপ। প্রকৃতির প্রতিশোধ নিষ্ঠুর।গাছকে নিয়েই একদিন চিপকো আন্দোলন হয়েছিল। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিজ এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অধিক গুরুত্ব দরকার। আমাদের মনে রাখা দরকার একদা অরণ্যই ছিল–দ্রাবিড়,শবর,কোল, মুণ্ডা প্রভৃতি উপজাতিদের আদি বাসস্থান। অরণ্যের বনজসম্পদ ছিল মানবিক উন্নয়ন এর মূল অঙ্গ। সুন্দরবনের মধু বিদেশেও প্রশংসিত।তাই অরণ্যসভ্যতাকে রক্ষা করাই আসন্ন বনমহোৎহসবে মানবজাতির মূল শপথ হওয়া উচিত।
Comments :0