হিন্দমোটর কারখানার অব্যবহত ৪০ একর জমি টিটাগড় ওয়াগান কারখানার তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সোমবার সিলমোহর দিল রাজ্য মন্ত্রীসভা।
কলকাতা হাইকোর্টে হিন্দমোটর কারখানার জমি নিয়ে স্থগিতাদেশ থাকার পরও কীভাবে রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেই প্রশ্ন তুলেছেন ট্রেড ইউনিয়ন। হিন্দমোটর কারখানার সঙ্গে যুক্ত ট্রেড ইউনিয়নের বক্তব্য,‘‘ ২০১৪ সালের ২৪ মে হিন্দমোটর কর্তৃপক্ষ মোটরগাড়ির কারখানায় সাসসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিস জারি করে। তারপর থেকে কারখানা পুরোপুরি বন্ধ। সেই সাসপেনশন অব ওয়ার্কের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে সিআইটিইউ। আদালত ওই সময় রায় দিয়ে হিন্দমোটর কর্তৃপক্ষের হাতে থাকা সমস্ত জমির হস্তান্তরের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে রাখে। তারপর কীভাবে টিটাগড় ওয়াগান কর্তৃপক্ষকে মন্ত্রীসভা জমি হস্তান্তরের অনুমতি দিতে পারে, সেই প্রশ্ন তুলেছে ট্রেড ইউনিয়ন। সিআইটিইউ হুগলী জেলা কমিটির সভাপতি মলয় সরকারের বক্তব্য,‘‘ আদালতের জমি হস্তান্তরের স্থগিতাদেশ থাকার পরও কীভাবে জমি হস্তান্তর হতে পারে? এই বেআইনি হস্তান্তরের বিরুদ্ধে আমরা আদালত অবমাননার মামলা করার জন্য প্রস্তুতি নেব।’’
রাজ্য মন্ত্রীসভায় সিদ্ধান্তের সাত দিন আগেই অবশ্য টিটাগড় ওয়াগান কর্তৃপক্ষ জমির দখল নিয়ে নেয়। গত ৭ জুলাই হুগলী জেলা প্রশাসনের সাহায্যে হিন্দমোটর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা রক্ষীদের সরিয়ে নিজদের নিরাপত্তাকর্মীদের জমিরও ওপর বসিয়ে দেয় ওয়াগান কারখানার কর্তৃপক্ষ। উত্তরপাড়া থানার পুলিশ ও স্থানীয় ভূমি রাজস্ব আধিকারিক(বিএলআরও)কে নিয়ে হিন্দমোটর কারখানার জমির দখল নেয় টিটাগড় ওয়াগান।
এদিন রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে পশ্চিমবঙ্গ সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইনের ৬(৩) ধারায় হুগলীর উত্তরপাড়া থানার কোতরং ও ভদ্রকালী মৌজার হিন্দমোটরস কারখানার অধীনে থাকা ৪০ একর জমি টিটাগড় রেল সিস্টেমস লিমিটেডের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । ৯৯ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লিজে এই জমি হস্তান্তর করা হয়েছে বলে রাজ্য মন্ত্রীসভা সূত্রে জানা গেছে। জমি দেওয়ার কারণ হিসাবে রাজ্য মন্ত্রীসভার বক্তব্য, সরকারি পুনরাধিকৃত জমিতে টিটাগড় কর্তৃপক্ষ রেলের কোচ সহ বন্দে ভারত কোচ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের কাছ থেকে জমি হাতে পাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত রেলের কোচ কিংবা বন্দে ভারত গাড়ির কোচ তৈরি করা নিয়েও সংশয়ে শিল্পাঞ্চলের মানুষ।
এলাকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের অভিযোগ, টিটাগড় ওয়াগান কারখানায় একজনও স্থায়ী শ্রমিক নেই। মূলত ঠিকা শ্রমিক দিয়ে চালানো হয় কারখানা। ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য করানো হয় অস্থায়ী শ্রমিকদের। যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশে শ্রম কোড আনতে চাইছে, টিটাগড় ওয়াগান কারখানায় কার্যত আগাম সেই ব্যবস্থা চালু আছে। অস্থায়ী কর্মীদেরও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। এরআগে কারখানায় কর্মরত অবস্থায় এক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর কোনোরকম ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। মৃত শ্রমিকের স্বার্থে কারখানার বাইরে থাকা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন লড়াই চালিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করে এনেছে।
২০০৬ সালে হিন্দমোটর কারখানা কর্তৃপক্ষকে অব্যবহৃত জমি বিক্রি করার প্রথম অনুমতি দিয়েছিল। হিন্দমোটর কারখানার মূলধনী সঙ্কট মিটিয়ে পুনরায় উৎপাদন চালু করার লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকার কারখানা কর্তৃপক্ষকে ৩১৪ একর জমি বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছিল। কারখানা প্রশাসন, রাজ্য সরকার, শিল্প পুনর্গঠন দপ্তর ও কারখানায় যুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন মিলিতভাবে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জমি বিক্রির শর্তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল, জমি বিক্রি হবে মূলত নির্মাণ নেই এমন পড়ে থাকা জমিই। একইসঙ্গে জমি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত টাকায় মেটাতে হবে শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া। ২০০৬ সালের ৪ মে ও ২৪ আগস্ট- রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। জমি বিক্রির সেই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই রাজ্য থেকে বিদায় নেয় বামফ্রন্ট সরকার।
তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর হিন্দমোটর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জমির হস্তান্তর হয়ে যায় শ্রীরাম গ্রুপ কাছের। এখন হিন্দমোটরের কারখানার জমিতে গড়ে উঠবে প্রায় ৫৪ হাজার ফ্ল্যাট। যারমধ্যে ৯ হাজারের ওপর ফ্ল্যাটের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেছে। ৬ হাজার ফ্ল্যাটের বিক্রিও পর্যন্ত করা সম্পন্ন। অথচ বিগত সরকারের শর্তের কোনও মর্যাদা না দিয়েই বর্তমান সরকার অবাধে চুক্তি লঙ্ঘন করে গেছে। এখন প্রায় ১১ বছর বন্ধ পড়ে থাকা হিন্দমোটর কারখানায় ২০০ -র ওপর শ্রমিক কর্মচারী আছেন। শ্রমিকদের নিজস্ব সমবায়ের গচ্ছিত ১ কোটি টাকার সঙ্গে বকেয়া টাকা পাওনা পড়ে আছে। তা নিয়ে বর্তমান রাজ্য সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই।
রাজ্য মন্ত্রীসভার এদিনের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে সিআইটিইউ হুগলী জেলা কমিটির সম্পাদক তীর্থঙ্কর রায় জানান, ‘‘শিল্পের জমিতে শিল্প গড়ার দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছি। আর আমরা গত ১২-১৩ বছরে দেখেছি, কীভাবে শিল্পের জমিতে প্রোমোটিং সহ অন্যান্য কাজ হচ্ছে। আর টিটাগড় ওয়াগান কারখানায় কোনো শ্রম আইন মানা হয় না। এই অবস্থা চলতে পারে না।’’
Hind Motors
শ্রমিকদের বকেয়া রেখে হিন্দমোটরের জমি হস্তান্তরে সিলমোহর রাজ্যের

×
Comments :0