JOYNAGAR WOMEN POLICE

জয়নগরে ঘরছাড়া মহিলাদের উপর হামলা পুলিশের

রাজ্য


অনিল কুণ্ডু : জয়নগর, 


 নিজেদের বাড়িতে ফিরবেন আশ্রয়হীন মহিলারা। তাঁদের পোড়া ভিটেয় কোনক্রমে থাকবেন, ত্রিপলের ছাউনিতে। তাতেও বাধা মমতা ব্যানার্জির সরকারের। সোমবার তৃণমূল সেই গরিব গ্রামবাসীদের ঘরছাড়া করেছিল। মঙ্গলবার পুলিশ তাঁদের গ্রামেই ঢুকতে দিল না।
পশ্চিমবঙ্গের কোন ‘নরকে’ বাস দেখিয়ে দিলো জয়নগর।
সোমবার ভোরে জয়নগরের বামনগাছির তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্কর খুন হন। তার বাহিনী আততায়ী সন্দেহে দুজনকে বেধড়ক মারে। একজন ঘটনাস্থলে মারা যায়। আর একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভরতি। এই খুনোখুনি তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বখরা, ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের। কিন্তু নজর সেখান থেকে ঘুরিয়ে দিয়ে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা, প্রায় চার কিমি দূরে দলুয়াখাকি গ্রামে হামলা চালায়। সিপিআই(এম)-র কর্মী, সমর্থকদের প্রায় ২০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় তারা। অন্তত ৩০টি বাড়িতে লুট করে। মহিলাদের শ্লীলতাহানি করে। গ্রাম ছাড়া করে ৩০টির বেশি পরিবারকে। রাতভর খোলা আকাশের নীচে ক্ষতিগ্রস্ত আক্রান্ত সর্বস্বান্ত পরিবার গুলি রাত কাটিয়েছেন। 
সেই পরিবারের মহিলারা মঙ্গলবার দুপুরে নিজেদের গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলুয়াখাকি থেকে প্রায় ৬ কিমি দূরে আটকে দেয় পুলিশ। যে পুলিশ সোমবার তৃণমূলের আক্রমনের খবর পেয়েও দেরি করেছিল পৌঁছতে, সেই পুলিশ মঙ্গলবার ঘরছাড়া মহিলাদের অনেক আগে রাস্তা আটকাতে হাজির হয়েছিল গুদামহাটে। প্রথমে ছিল পুলিশ বাহিনী, যে বাহিনীতে কোনও মহিলা পুলিশ ছিলেন না। সেই পুলিশ ব্যারিকেডের পরে, আরও কিছুটা দূরে রাস্তা আটকে রাখা ছিল পুলিশের গাড়ি। সেই ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন মহিলারা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সিপিআই(এম)-র নেতৃত্ব। পুলিশ মেরে আটকেছে মহিলাদের। মর্জিনা লস্করের কথায়,‘‘গতকাল(সোমবার) ওরা আমাদের ২টো ঘর পুড়িয়েছিল। ২টো সেলাই মেশিন, খাবারদাবার, বাসন, তক্তপোষ, খাট, চেয়ার, যা ছিল সব পুড়িয়েছিল। দশ হাজার টাকা ঘরে ছিল সংসার চালানোর। তাও লুটে নিয়ে গেছে। আমার মেয়েটা (আলিমা লস্কর) মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। তার বই খাতাও পুড়েছে। কিচ্ছু বাকি রাখেনি। আর আজ আমি ঘর যেতে চাইছি বলে পুরুষ পুলিশ দিয়ে আমাকে মারল। এরা আমাদের বাঁচতে দেবে না!’’
একই সুর ছিল আরও অনেকের মুখেই। আলিমা বিবিও পুলিশের আক্রমনের শিকার হয়েছেন এদিন। তাঁর কথায়,‘‘আমার একটা পাকা ঘর, একটা মাটির ঘর, একটা মুদি দোকান ছিল। একটা গোয়াল ঘর — সেটাও পুড়িয়েছে। তার আগে সোনা যেটুকু ছিল লুট করেছে। টাকা নিয়ে নিয়েছে। আমাদের রেশন কার্ড ছাড়া যা যা কাগজ ছিল সব জ্বলেছে। আজ ভেবেছিলাম বাড়ি যাবো। কোন রকমে ত্রিপল দিয়ে থাকবো। পুলিশ মেরে তাড়িয়ে দিল?’’
মঙ্গলবার সকালে আক্রান্ত ওই ৩০টি পরিবারের মহিলারা দক্ষিণ বারাসতে সিপিআই(এম) জয়নগর ১ এরিয়া কমিটির দপ্তরে আসেন। সেখানে তাঁদের দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, কান্তি গাঙ্গুলি, রাহুল ঘোষ, রতন বাগচী, প্রভাত চৌধুরী সহ অন্যান্য নেতৃত্ব আক্রান্ত মহিলাদের সঙ্গে দলুয়াখাকি গ্রামে যাওয়ার জন্য রওনা হন। গুদামেরহাটে পুলিশ বাহিনী তাঁদের বাধা দেয়। ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে পার্টি নেতা কান্তি গাঙ্গুলির পায়ে আঘাত লাগে। 
এদিন ভাঙড়ের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকিও দলুয়াখাকিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁকে পুলিশ যেতে দেয়নি। যদিও সিপিআই(এম) নেতৃত্ব, ঘরছাড়া মহিলাদের মতোই আইএসএফ বিধায়ককেও ১৪৪ ধারার নির্দেশ বা পথ আটকানোর অন্য কোনও নির্দেশিকা পুলিশ দেখাতে পারেনি।
এদিন পুলিশের বাধার প্রতিবাদে বেশ কিছু সময় পথ অবরোধ বিক্ষোভ করেন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ও আক্রান্ত মহিলারা। এরপর সেখান থেকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে জয়নগর থানায় আসেন পার্টি নেতৃত্ব। তাঁরা পুলিশের কাছে দাবি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ওই পরিবার গুলিকে গ্রামে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নিরাপত্তার দাবি করে ওই গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প করার দাবি জানানো হয়। ভস্মীভূত গ্রামের ওই বাসিন্দারা গ্রামে ঢুকতে না পেরে তাঁরা থানায় আসেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব। মহিলারা অভিযোগ দায়ের করেন জয়নগর থানায়। এদিন আক্রান্ত সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকদের ত্রাণের ব্যবস্থা করেন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব। গ্রামে ঢুকতে পুলিশ বাধা দেওয়ায় জয়নগর থানার মধ্যেই তাঁদের হাতে ত্রাণ তুলে দেওয়া হয়। এদিন রাতে জয়নগর থানায় আসেন বারুইপুরের এসডিপিও। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন পার্টি নেতৃত্ব। আক্রান্ত গৃহহীন পরিবারের মহিলাদের বুধবার সকালে দলুয়াখাকি গ্রামে ফেরানোর আশ্বাস দেন তিনি।
সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী বলেন,‘‘আগে গোটা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ(মঙ্গলবার) মহিলাদের উপর পুলিশ অত্যাচার করেছে। খুনীদের গ্রেপ্তার ও দলুয়াখাকি গ্রামে হিংসার ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা না হলে ২৭ নভেম্বর জয়নগর থানায় অভিযান হবে।’’ সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘রাজ্য সরকার অপদার্থ।‌ গৃহহীন পরিবারের পাশে দাঁড়াবে সিপিআই(এম)। কোথায় বিডিও, এসডিও। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছে তাঁরা। এই পরিবারগুলোর ব্যবস্থা কি হবে।’’ কান্তি গাঙ্গুলি বলেন,‘‘এলাকায় শান্তি চাই। কারো মায়ের কোল যেন শূন্য না হয়। অপরাধীদের শাস্তি চাই। বগটুইয়ে, বিষমদে সরকার ২লক্ষ টাকা দিলে দলুয়াখাকি গ্রামের অসহায় মানুষ কেন পাবে না‌?’’ 
এদিন আইএসএফ-র পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে,‘‘এই ঘটনা যেন বগটুইয়ের মতো ধামাচাপা না পড়ে ও এই খুনের সঠিক তদন্ত যাতে হয়, সেই দাবি নিয়েই বিধায়ক যাচ্ছিলেন। পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতি করে বলে আর যাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হল তাঁদের পাশেও তিনি থাকতে চেয়েছিলেন। আইএসএফ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি পুলিশের এই অতি সক্রিয়, অগণতান্ত্রিক আচরণের তীব্র নিন্দা করছে। এই সক্রিয়তা গতকাল ঘরদোর পুড়িয়ে দেওয়ার সময় কোথায় ছিল, সেই প্রশ্নও দল করছে। আক্রান্ত সকল পরিবার যাতে আইনের মাধ্যমে সুবিচার পান এবং যাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সরকার যাতে শীঘ্রই তাঁদের ক্ষতিপুরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সেই দাবি আইএসএফ করছে।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment