Kalim Sharafi birth centenary

শতবর্ষে কলিম শরাফি

আন্তর্জাতিক

গৌতম রায়

পঞ্চাশ বছর আগে যে মানুষটি জন্মগাঁ খয়রাডিহি ছেড়েছিলেন, উপমহাদেশের আর্থ- সামাজিক- রাজনীতির নানা ওলটপালটে সেই গাঁয়ে আর তাঁর পা দেওয়া হয় নি। ভারত ও বাংলাদেশ-- দুটি দেশের স্বাধীনতার যোদ্ধা, ব্রিটিশ বিতাড়নের ব্রত নেওয়ার জন্যে যে মানুষটিকে শৈশব- কৈশোরের সন্ধিক্ষণে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে বীরভূমের সিউরির জেলে- সেই মানুষটি বাংলাদেশে ' ৭৫ উত্তর কঠিন সময়েও প্রাণের টানে এপার বাংলায় এসেছেন পত্নী নওশেবাকে সঙ্গে নিয়ে। 

কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাপ আজমের গণ আদালতে বিচারপর্বে সংযুক্ত থাকবার কারনে বাংলাদেশের সেইসময়ের সরকার বাহাদুরের দ্বারা ' দেশদ্রোহিতা' র মামলা মাথায় নিয়েও এসেছেন তাঁর প্রাণের শহর কলকাতাতে। কিন্তু কেউ তাঁকে সেই খয়রাডিহি গ্রাম, যেখানে তাঁর নাড়ি পোঁতা আছে, সেখানে একবার নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়নি।

খয়রাডিহি ছেড়ে আসার পঞ্চাশ বছর পরে জন্মভূমির মাটি ছোঁয়ার সুযোগ কলিম শরাফিকে করে দিয়েছিলেন একুশ শতকের প্রথম দশকের শুরুতে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী মহম্মদ সেলিম। পঞ্চাশ বছর আগে শেষবার শান্তিনিকেতনের মাটি স্পর্শ করা কলিম আবার শান্তিনিকেতনের পথ বেয়ে এলেন সিউরিতে। আসার পথে প্রথমেই গেলেন তাঁর ' মোহরে' র বাড়ি। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন প্রয়াত। গেলেন ' সুবর্ণরেখা' তে। 

সিউড়ি যাওয়ার পথে শান্তিনিকেতন পেরোতে তাঁর ' মোহরে' র বাড়ি ছাড়াও কলিম গেলেন '৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে একসঙ্গে জেল খাটা দিনকর কৌশিকের বাড়ি। দিনুদা তখন বেশ অসুস্থ ই। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর দুই বন্ধুর সাক্ষাৎ। অনিবার্য ভাবেই উঠে এলো, দিনুদার শান্তিনিকেতনের সহপাঠী' মানিকে' র কথা। দিনু কৌশিকের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল কলিমের। 

আসলে সেই সময়ে কলিমের বড় ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু ' কমিউনিস্ট' কলিমকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হতে দেননি অনিল চন্দ, যেমন সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজেও বিদ্যাসাগরের উইল ঘিরে অসত্য তথ্য দিয়ে ' মুসলমান' হওয়ার দায়ে ভর্তি হতে দেননি মিহিরলাল চট্টোপাধ্যায়।

কলিম তখন সিউড়ি সার্কিট হাউজে উঠেছেন। সন্ধ্যে বেলায় দেখা করতে এলেন বীরভূম জেলা সিপিআই (এম) এর তৎকালীন সম্পাদক মহম্মদ সেলিম । এলেন তৎকালীন সাংসদ রামচন্দ্র ডোম সহ অনেকে। স্মৃতির নদী যেন সাঁতার কাটছেন তখন কলিম শরাফি। বারে বারেই কলিমেল কথাতে উঠে আসছেন তাঁর শরদীশদা( শরদীশ রায়) । বীরভূম, কমিউনিস্ট পার্টি , গণনাট্য, রবীন্দ্রনাথ , বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু--- সব যেন সেদিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

 পরের দিন , শীতের কুয়াশা ঠেলে সিউরি থেকে গাড়ি যত এগিয়েছে রাজনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের দিকে কলিম ও তাঁর পত্নী নওশেবা খাতুন তত ই যেন স্মৃতি গহীনে ডুব দিয়েছেন।গাড়ি থেকে খয়রাডিহির ' সাঁকো' দেখতে পেয়ে দুজনেই প্রায় আনন্দে শিশুর মত চিৎকার করে উঠলেন। তৎকালীন রাজনগর পঞ্চায়েত সমিতি এক অনবদ্য শোভাযাত্রা সহকারে , রায়বেশে নৃত্যের একটা দল ছিল সেই শোভাযাত্রায়, তাঁদের নিয়ে গেল বাড়ির ভিতরে। কলিম দাঁড়ালেন সেই বড় টিনের একচালা ঘরটার সামনে যেখানে ১৯২৪ সালের ৮  মে তিনি পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। এই একচালার পাশ থেকেই '৪২ এ ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। তৎকালীন পঞ্চায়েত সমিতি খয়রাডিহিতে কলিমের যে সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছিল , সেখানে কলিম কেবল একটা বাক্য ই বলেছিলেন; আমার সন্তানপ্রতিম সেলিমের জন্যে পঞ্চাশ বছর পর জন্মস্থান, যেমাটিতে আমার নাড়ি পোঁতা আছে, সেই মাটিকে দেখতে পেলাম।হয়ত জীবদ্দশাতে আর এখানে আসা হবে না, কিন্তু এই মাটিতে মিশে থাকবার ইচ্ছাই জীবনের আকাঙ্খা।তারপর কলিম গাইলেন তাঁর বটুকদার ' নবজীবনের গানে' র একটা কলি;' জেলেরা বুনবে নূতন জাল, মাছের রূপোয় ঝলসে উঠবে, পল্লীর যত হতাশায় নেভা চোখ।' 

                         শৈশবেই মাতৃহারা হন কলিম।মা মরহুমা বেগম আলিয়ার স্মৃতি কলিমের জীবনে প্রায় কিছুই ছিল না। কলিম শরাফির নিজের কথায়; শৈশবে মাতৃহারা হওয়ার দরুণ কিছুটা বাউন্ডুলেপনার ভিতর দিয়েই তাঁর ছোটবেলাটা কেটেছিল।তাই পড়াশুনার ফাঁকে কৈশোরে তাঁর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া-- এসব বিষয়ে কখনো কোনো পারিবারিক প্রতিবন্ধতা তাঁকে পেতে হয় নি ।শৈশব- কৈশোরে পারিবারিক স্তরে একটু অবহেলার ভিতর দিয়ে বড়ো হওয়া ঘিরে কলিমের মনের গভীরে কোথাও একটা ক্ষত চিরকাল ছিল।

                     ইস্কুল জীবনেই হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে কলিম যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তার জন্যে , সেই প্রথম কৈশোরেই তিনি সুভাসচন্দ্র বসুর বিশেষ প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই প্রথম ব্রিটিশ পুলিশের লাঠিতে কলিমের মাথা ফেটেছিল ,আর তাঁর শুশ্রষায় ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। এইসময়কালটাতে ক্যালকাটা মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন কলিম।সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন শহিদুল্লাহ কায়সার।

                        দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে কলিম বীরভূমে ফিরে এসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন।এই সময়েই '৪২ এর আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়েন।ভারতরক্ষা আইনে কারারুদ্ধ হয়ে দেড় বছর তাঁকে জেলে কাটাতে হয়।এই পর্বেই কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, রাণী চন্দদের সঙ্গে তিনি বন্দি ছিলেন।

                   জেলেই বসেই কমিউনিস্টদের সঙ্গে কলিম শরাফীর পরিচয়।জেল থেকে বেরিয়ে সেই পরিচয় ক্রমে নিবিড় হলো। দুর্ভিক্ষের ত্রাণে গণনাট্য সঙ্ঘের কর্মী হিশেবে তিনি আত্মনিয়োগ করলেন।সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহের পরাবারের মহিলারা সেই সময়ে নারী আত্মরক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে যে লঙ্গরখানা বর্ধমানে চালিয়েছিলেন, সুফিয়া কামালের যে লঙ্গরখানার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল, কলিমের ও সঙ্গেই সেই ত্রাণকার্যের একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।হোসেন শাহিদ সোহরাওয়ার্দী স্বয়ং প্রচ্ছন্ন ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা পরিচালিত বর্ধমানের ত্রাণ শিবিরটিতে গিয়েছিলেন।

                  গণনাট্য সঙ্ঘ আর তার পরিবেশ ই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল কে অতিক্রম করে কলিমকে আকৃষ্ট করেছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, ভূপতি নন্দী, সুরপতি নন্দী, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি ভাদুড়ি( মিত্র), সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়( মিত্র) , দেবব্রত বিশ্বাস, মহঃ জাকারিয়া, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, খালেদ চৌধুরী--- এই পরিমন্ডলের একজন হয়েই মন্বন্তরের বিরুদ্ধে ' নবজীবনের গান' কে সঙ্গী করা কলিম ' ৪৬ এর ১৬ ই আগস্টের একদিন আগে উত্তাল কলকাতা থেকে গণনাট্যের ই কাজে গিয়েছিলেন গণনাট্যের কর্মী বীণা চৌধুরীর বাড়ি হাওড়ার রামরাজাতলায়।রাজনীতির উত্তাল পরিস্থিতিতে সেদিন তিনি কলকাতায় ফিরতে পারলেন না।পরের দিন হাওড়া স্টেশনে নেমে দেখলেন সেই ভয়াবহকতাকে। কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না কলিম।স্টেশন চত্ত্বেরের বাইরে এসে দেখলেন ইতস্বত লাশ পড়ে আছে।ধীরে ধীরে কিছু বুঝছেন, কিছুটা শুনলেন।রেডক্রসের একটা গাড়ি পি জি হাসপাতালের সামনে যে গুরুদ্বারটা আছে, সেখানে রেডক্রসের গাড়ি নামিয়ে দিল তাঁকে।উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতেই কলিমের সামনে পড়ে গেলেন সমরেশ রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সহকারী।' মুসলমান' কলিম কে সেদিন রাস্তায় চিনতে অস্বীকার করেন সমরেশ রায়।যন্ত্রণাকাতর কলিম , হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন তাঁর ' কমরেড' সুচিত্রার বেণীনন্দন স্ট্রীটের বাড়িতে।সুচিত্রা তখন বাড়িতে ছিলেন না।

কোনোক্রমে কলিম এলেন ট্রাঙ্গুলার পার্কে, তাঁর জর্জদা, দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে।সেবাড়িতে তখন সদ্য বিবাহিত শম্ভু- তৃপ্তি মিত্র এসেছেন বম্বে থেকে।কলিমের জর্জদা, শম্ভু- তৃপ্তির খাটের তলায় কার্যত লুকিয়ে রাখলেন তাঁর ভাই কলিমকে।যেকোনো ভাবেই হোক পাড়াতে খবর রটে গেছে দেবব্রত তাঁর বাড়িতে এক ' মুসলমান' কে আশ্রয় দিয়েছেন।হিন্দু মহাসভার ছেলেরা চড়াও হয়েছে দেবব্রতের বাড়িতে।তাদঃর মুখের উপরে দেবব্রত তাঁর অভ্যস্থ গালাগাল,' শ্যাটআপ ইউ আর দি মিডলক্লাস ' বলে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।

 ' নবান্ন'  র প্রথম কয়েকটি শো তে অভিনয় করেছিলেন কলিম। শম্ভু মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কটা কলিমের এমন ই হয়েছিল যে, পারিবারিক বৃত্তে ' মেজদা' বলে সম্বোধিত শম্ভু মিত্র ও হয়ে গিয়েছিলেন কলিমের মেজদা।শেষ জীবনে ক্যান্সারে যখন কলিমের মেজদা জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেছেন, তখন তাঁর কলিমের গান ছাড়া আর কারো গান ই শুনতে পছন্দ করতেন না শম্ভু মিত্র।' নবান্নে' চেরাগ হাতে ফকিরি গানের একটা দৃশ্যে কলামকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন শম্ভুবাবু।' বহুরূপী' র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন কলিম। শম্ভু মিত্রের দীর্ঘকালের বাসস্থল ১১ এ নাসিরুদ্দিন রোডের বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল কলিম শরাফির নামেই।

 '৪৬ এর ১৬ ই আগস্টের পর কলকাতায় সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারে কমিউনিস্ট পার্টির তরফে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ,সেখানে কলিম শরাফির ছিল এক ব্যতিক্রমী ভূমিকা।গণনাট্য সঙ্ঘের উদ্যোগে দাঙ্গা করলিত এলাকায় কলিমের কন্ঠে , প্রেমধবনের গান,' শুনহ্ হিন্দ কে রহনেওয়ালে, তুম শুনো শুনো', আর সুচিত্রার কন্ঠে ,' সার্থক জনম আমার' যেন একেবারে ম্যাজিকের  মত কাজ করেছিল।তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী তারাশঙ্কর কলিমদের সেইসব মিছিলে বেশ কয়েকবার শামিল হয়েছিলেন।জীবন উপান্তে সুচিত্রা বলতেন; কলিম , মনে আছে শিখ মানুষজনেরা আমাদের ট্রাকের সবাইকে কি অসাধারণ মালাই চা খাওয়াতেন!

 '৪৯ সাল এবং তার পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান কলিম মেনে নিতে পারেন নি।গোলাম কুদ্দুসের মত লোকেদের তখন বক্তব্য ছিল, এইসব আবদুল করিম খাঁ , ফৈয়াজ খাঁ থেকে শুরু করে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে দেওয়া উচিত।

জীবৎ কালে পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র ' নন্দন' পত্রিকাকে নয়ের দশকের শেষের দিকে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কলিম শরাফি।সেখানে তাঁর সেদিনের সঙ্কট এবং সাংস্কৃতিক প্রশ্নে একাংশের কমিউনিস্ট মৌলবাদীদের ভূমিকা তিনি অকপটে বলেছিলেন।যদিও নিজের সেদিনের ভূমিকা তখন অস্বীকার করেছিলেন গোলাম কুদ্দুস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে চলে যাওয়ার আগে বিষ্ণু দের ' সাহিত্যপত্র' প্রকাশ কে কলিম বলতেন; আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

 তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানে স্বভাবসুলভ ভাবেই মুক্তবুদ্ধির অসাম্প্রদায়িক , মুসলিম জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র বিরোধী মানুষদের সঙ্গেই কলিম শরাফির সখ্যতা তৈরি হলো।পূর্ব পাকিস্থানে রবীন্দ্রনাথের গানকে সবস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কলিম শরাফির অবদান ঐতিহাসিক।পাক হানাদারদের আক্রমণ কালে  স্বঘোষিত রবীন্দ্রপ্রেমীর মতো শান্তিনিকেতনে বসে কলিম নিজের কেরিয়ার তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন নি।বিদেশে , বিশেষ করে মার্কিন মুলুক, যেভাবে হানাদার পাক বাহিনীর সমর্থকের অভাব ছিল না, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার, অর্থ সংগ্রহ, বঙ্গবন্ধুর পাক কারান্তলে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবার জন্যে কলিম যে লড়াই করেছিলেন তা '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আইয়ুব খানের বিভাজনের রাজনীতির স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব পাকিস্থানের গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ করবার ক্ষেত্রেও কলিম শরাফির রবীন্দ্রনাথের গানে জনপ্রিয়তা ঘিরে ঈর্ষা একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল।পাকিস্থান আমলে সামরিক জান্তা থেকে রবীন্দ্রনাথকে মুক্ত করবার ক্ষেত্রেও সুফিয়া কামাল আর কলিম শরাফির ভূমিকা এবং অবদান ছিল ঐতিহাসিক।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশে যে কজন বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন সুফিয়া কামাল ,কবীর চৌধুরী , শামসুর রাহমান এবং কলিম শরাফি।বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে সোচ্চার হবার অনেক দায় শেষ বয়সে কলিম শরাফিকে চোকাতে হয়েছিল। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে '৯২ এর ২৬ শে মার্চ যে প্রতিকি গণ আদালত হয় ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে , সেখানে বিচারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন কলিম শরাফি।সেই ' অপরাধে' খালেদা জিয়ার সরকার কলিম শরাফি সহ গণ আদালতের সব বিচারক, সংগঠকদের বিরুদ্ধেই দেশদ্রোহিতার আমলা করেছিল।শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে সেই মামলা মাথায় নিয়েই মৃত্যুবরণ করতে হয়।শেখ হাসিনা প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে ওই মামলা প্রত্যাহার করেন।একুশ শতকের গোড়াতে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ভারতের তৎকালীন বাজপেয়ী সরকার, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ এবং সেদেশের তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার কিভাবে একযোগে সক্রিয় ছিলেন, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সেই সত্য প্রকাশে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সরে আসেন নি কলিম শরাফি।

Comments :0

Login to leave a comment