Pahalgam Terror Attack

কায়দা বদলেছে সন্ত্রাসবাদ, গুরুত্ব দেননি মোদী-শাহরা

জাতীয়

বুধবার বৈসরনে অমিত শাহকে ঘিরে নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানরা। মঙ্গলবার এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য এক জন জওয়ানও ছিল না।

বুধবার সকালেই পাইন বন ঘেরা ওই বুগিয়ালের আকাশে চক্কর কাটছে অমিত শাহের হেলিকপ্টার। কাল দুপুরে যে চত্বরে সন্ত্রাসবাদীদের গুলি ঝাঁজরা করে দিয়েছে ২৬টি শরীরকে, আজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সেই ‘শান্ত, স্বাভাবিক’ কাশ্মীরের বৈসরনে এসেছেন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। কী দেখলেন কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করে ফেলার দাবিদার শাহ? সৌদি সফর কাটছাঁট করে দেশে ফেরার আগেই মোদী নাকি তাঁকে শ্রীনগরে পাঠিয়ে দিয়েছেন পরিস্থিতি সামলাতে। সেই ২০১৯ থেকে ডাহা ফেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ফাঁকা আস্ফালন ছাড়া আর কী বদলাতে পারবেন, প্রশ্ন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের। ধীরে ধীরে পর্যটন মানচিত্রে জায়গা ফিরে পাওয়া কাশ্মীরে গতকালের হামলা যে শান্তি বিঘ্ন করতে আর পর্যটন সম্ভাবনার কাছে বড় ধাক্কা, এ কথা সকলেই বুঝেছেন। উপত্যকার বাসিন্দাদের প্রশ্ন, সুরক্ষা নিয়ে এত আস্ফালন, তা এতটা ফাঁপা কেন? তাঁদের প্রশ্ন, গোয়েন্দারা কী করছিল? নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানরা আজ অমিত শাহকে চার দিক ঘিরে রেখেছে, কাল তাঁদের এক জনও কেন মোতায়েন ছিলেন না বৈসরনে? যেখানে ২ হাজার পর্যটক ছিল। 

সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে প্রায় ৩.৪৩ লক্ষ নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১.৬৮ লক্ষ সেনাবাহিনীর সদস্য, ১.১২ লক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এবং ২.৩১ লক্ষ অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছেন। মানে এই পহেলগামে, বৈসরনের এই সব এলাকায়। সেখানে এমন রক্তক্ষয়ী হামলা হয় কী করে? বৈসরনের হামলা যে নিরাপত্তা-গোয়েন্দা ব্যর্থতার এক রক্তাক্ত নজির একথা বলছেন সকলেই। মোদী-শাহ যতই প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা চালান, আড়াল করতে পারছেন না এই ব্যার্থতাকে। 

‘কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের মাজা ভেঙে দিয়েছেন মোদী’ এমন দাবি করা অমিত শাহ আজ অবশ্য বলেছেন, ‘ভারত’ সন্ত্রাসবাদের কাছে মাথা নোয়াবে না। পুলওয়ামার পরও তো অনেক ছবি, মানচিত্র প্রকাশ হয়েছিল! আজ পর্যন্ত সেই তদন্তের ফলাফল সামনে আসেনি। ৩৭০ ধারা রদ করে কাশ্মীরকে মেইন স্ট্রিমে নিয়ে আসার দাবিদাররা কী করে অবহেলা করলেন টিআরএফ-র মতো সংগঠনের বেড়ে ওঠাকে। এমন এক সময়ে এই হামলা হলো যখন মার্কিন উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স ভারত সফরে। নয়ের দশকে ব্যাপারটা যেমন আকছার ঘটত। বিদেশি কোনও নেতা-প্রতিনিধি ভারত সফরে আসা মানেই কাশ্মীরে বড় কোনও হামলা। ছত্তিসিংপুরা গণহত্যার মতো নজির রয়েছে। এবার সেই ধাঁচের হামলা, কিন্তু ভিত টলিয়ে দেওয়ার মতো। আশি-নব্বইয়ের দশকের পরে পর্যটকরা এমন হামলার শিকার— ঘটেনি উপত্যকায়। মোদীরা মানুক না মানুক, কাশ্মীর এক নতুন ধরনের সন্ত্রাসবাদের মুখোমুখি। গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, উপত্যকায় এখন জনা ষাটেক বিদেশি সন্ত্রাসবাদীর উপস্থিতি আছে, যাদের অর্ধেকই 'দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট' (টিআরএফ)-এর সঙ্গে যুক্ত। এই টিআরএফ কারা? তথ্য বলছে এরা হলো লস্কর-ই-তৈবা’র একটি ছায়া সংগঠন। যা তুলনামূলকভাবে নরম ও স্থানীয় ধাঁচের নাম ব্যবহার করে এরা আন্তর্জাতিক নজরদারির বাইরে থাকতে চায়।

এদের কৌশলটা হলো হাইব্রিড টেররিজম। এর কারণেই টিআরএফ বা এদের মতো অন্যান্য গোষ্ঠীগুলি অনেক বেশি বিপজ্জনক। এই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত সীমান্ত পার থেকে আসা সন্ত্রাসবাদীর দরকার পড়ে না। পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় স্থানীয়ভাবে চরমপন্থায় প্রভাবিত যুবকদের, যারা সাধারণ নাগরিকের ছদ্মবেশে কাজ করে, হাতে পিস্তল বা গ্রেনেড তুলে নিয়ে টার্গেট কিলিং চালিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়। এদের কার্যকলাপে থাকে না কোনও ডিজিটাল ছাপ, পরিবারিক সংযোগ, কিংবা এমন কোনও চিহ্ন যা নিরাপত্তা বাহিনী শনাক্ত করতে পারে। এটি এক ধরনের ‘ছায়া সন্ত্রাসবাদ’, যা প্রথাগত গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করতে পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। বছর ছয়েক পিছিয়ে গেলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর গঠিত হয় টিআরএফ এবং ২০২৩ সালে মোদী সরকার এদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করে। ‘টার্গেটেড কিলিং’-এ হাত পাকানো এই গোষ্ঠী উপত্যকায় বেছে বেছে খুন, ছুটিতে আসা বাহিনীর জওয়ান কিংবা রাজনৈতিক নেতাকে মেরেছে। এতদিন এরা শহর বা জনবহুল এলাকায় পিস্তল বা একে ৪৭ রাইফেল নিয়ে হামলা চালিয়ে গা ঢাকা দেয়। এমন তরুণদের বেছে নেয় যাদের কোনও অপরাধের রেকর্ড নেই। দু-একটা অপারেশন করে গা ঢাকা দেয়। এই টিআরএফ দারুনভাবে প্রযুক্তি আর প্রোপাগান্ডাকেও ব্যবহার করে। সোশাল মিডিয়া আর এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করে। কাশ্মীরি তরুণদের উসকে ‘মগজ প্রক্ষালনের’ সঙ্গে এরা বিজেপি’র আইটি সেলের চেয়েও তড়িৎ গতিতে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নানা তথ্য ছড়ায়। ৩৭০ ধারা বাতিলের পরে ‘সন্ত্রাসবাদ শেষ’ বলে যখন বুক চাপড়াচ্ছেন মোদী-শাহরা। তখন কায়দা বদলে নিয়েছে সন্ত্রাসবাদ। গুরুত্ব দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। 

এই অবস্থায় যখন স্পর্শকাতর এলাকাগুলোর ওপর নিরাপত্তা জোরদার করার কথা, তখন বাস্তবে, হুমকি যাচাই ও প্রতিরোধমূলক মোতায়েনের ক্ষেত্রে একটি বড় ফাঁকফোকর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মঙ্গলবারের ঘটনায়। বিপুল নিরাপত্তা বাহিনী যা কাশ্মীরে মোতায়েন, তখন কোথায় ছিল? প্রশ্ন উঠছেই, কোথায় ছিল নজরদারি? এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী টহল হঠাৎ করে কমে যাওয়াটাও বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, বিশেষ করে সেইসব অঞ্চলে যেগুলো সবসময় ইলেকট্রনিক নজরদারির আওতায় নেই। পাহাড়ি রুটগুলোকে শুধুমাত্র ড্রোন ফিড ও জিও-ফেন্সিংয়ের মাধ্যমে সুরক্ষিত রাখা যাবে এই বিশ্বাস শুধু ভুল নয়—তা বিপজ্জনকও বটে। নিরাপত্তার গাফিলতি চেপে গিয়ে ফলাও প্রচার হচ্ছে,  হামলাকারীদের খোঁজে এলাকায় চলছে ড্রোন নজারদারি। যেন এই প্রথম। মোদীর আগে কখনও কোনও সময় এমন নজরদারি হয়নি। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অমিত শাহরা ভুলে গেছেন পাহাড়ি জমিতে শারীরিক উপস্থিতির কোনও বিকল্প নেই। ড্রোন নজরদারি করতে পারে, ক্যামেরা রেকর্ড করতে পারে, আর যোগাযোগের গোপন বার্তা ধরা পড়লে সতর্কতা জারি হতে পারে — কিন্তু এগুলোর কোনোটাই মাঠে থাকা জওয়ানদের অভিজ্ঞতা, উপস্থিতি ও প্রতিরোধ ক্ষমতার সমান হয় না। কখন কী ঘটলো, সেই মতো প্রতিক্রিয়া-টহলদারি-অভিযানের ফথ থেকে সরে গিয়ে আগাম আন্দাজ করে সেটাকে আটকানোর কৌশল নিতে হবে। পহেলগাম, গুলমার্গ ও সোনমার্গের মতো পর্যটনস্থলগুলির রাস্তাগুলিকে বহুমুখী নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে, যেখানে থাকবে স্থায়ী টহল ইউনিট ও পালাক্রমে অভিযান চালানোর মতো গোয়েন্দা দল।

তবে একই সঙ্গে সতর্ক থাকতে হবে যাতে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান সাধারণ নাগরিকদের বিচ্ছিন্ন না করে ফেলে। এই কথাটাই মোদী-শাহরা বোঝেন না। ‘নাম জিজ্ঞাসা করে গুলি চালিয়েছে’ এমন খবর মিডিয়ায় যে গুরুত্ব পেল, সে গুরুত্ব পেল না সন্ত্রাসবাদীর হাত থেকে বন্দুক কাড়তে গিয়ে গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া ঘোড়াওয়ালা সৈয়দ আদিল হুসেইন শাহের সাহসিকতার গল্প। সন্ত্রাস দমন ও সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করা — এই দুটি বিষয়ের মাঝে সীমারেখা অতিক্রম করা যাবে না। ভারতের বাকি অংশের মতোই কাশ্মীরের সাধারণ মানুষও বিদেশ-প্রভাবিত সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার।

এছাড়াও, উপত্যকার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার নেতৃত্ব কাঠামো পুনর্বিবেচনার একটি জোরালো প্রয়োজন রয়েছে। এমন মাত্রার সন্ত্রাসবাদী হামলা কোনও ফাঁকা জায়গায় ঘটে না। শুধুই কথার ঝড়ে কিছু হবে না, কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। ব্যর্থতা আড়ালে হুঙ্কার আর উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে কাজ হবে না, বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট বলছেন, এবার মানসিকতা বদলান মোদী। কাশ্মীরে নেতৃত্ব শুধু প্রতীকী হতে পারে না — এটি বাস্তব ও কার্যকর হতে হবে। দিল্লিকে বুঝতে হবে শ্রীনগরেও একটা সরকার আছে। এবং মানুষের নির্বাচিত সরকার। এক রাতের মধ্য শ’দেড়েক আমলা বদলি নয়, কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাস অর্জন করাটা অনেক বেশি জরুরী।

 

Comments :0

Login to leave a comment