অনির্বাণ দে (বহরমপুর) ও প্রবীর দাস (বসিরহাট)
কাজে নেই সুরক্ষা। নেই সরকারি নজরদারি। ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে নেই সরকারের সহানুভূতিও। মুর্শিদাবাদের লালগোলায় টিকরপাড়া আর আইরমাড়ি জুড়ে শুধুই স্বজন হারানো হাহাকার। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির পুরুষই নির্মাণশ্রমিক, পাইপলাইনের শ্রমিক হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজে যান। বড় অংশই নিকাশিনালায় কাজ করেন।
গ্রামে চাষে খরচ বাড়ছে, কৃষিতে আয় কমছে। প্রতিদিন আরও বেশি যুবকরা ছুটছেন গ্রাম ছেড়ে বাইরে। রেহাই নেই বয়স্কদেরও।
সেরকমই কাজে গিয়েছিলেন বছর ষাটের ফরজেম শেখ। কিন্তু রবিবার বাড়তি এসেছে ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। ইটের গাঁথনি দেওয়া টালির চালের বাড়িতে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। ফরজেম শেখের স্ত্রী আসরাফুন্নেশা বিবি শোকে পাথর।
ভিনরাজ্যে কাজে যাচ্ছিলেন ফরজেম শেখের ছোট ছেলে সাদ্দাম হোসেন। বাবার মৃত্যুর খবরে তিনিও ফিরে এসেছেন গ্রামে। পরিবার চাইছে, সরকারি সাহায্য।
বুক ফাটা ছবি লালগোলার ঠিকরপাড়ায় তরুণ হাসিবুর রহমানের বাড়িতে। হাসিবুরের বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধ বাবা নাজিমুদ্দিন সেখ, মা তাসমিরা বিবি। রয়েছেন স্ত্রী সারবান তোহরা বিবি, এক বছরের মেয়ে হাসিবা জান্নাত। মেয়েকে বড় করব কীভাবে, আমাদের পাশে কে থাকবে, প্রশ্ন সারবার তোহরা বিবির।
কিন্তু কোথায় সরকার? প্রশ্ন দুই পরিবারের। এখনও ব্লক প্রশাসন বা সরকারি কোনও দপ্তর যোগাযোগ করেনি পরিবারের সঙ্গে। ক্ষতিপূরণ নিয়েও সংশয়ে পরিবার।
রবিবার মৃত দুই শ্রমিকের বাড়ি যান সিপিআই(এম) মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা, পার্টি নেতা সচ্চিদানন্দ কান্ডারী, জামাল হোসেন, বাবলুজ্জামান। ছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান রওসন জামান, পঞ্চায়েত সমিতির সহসভাপতি জিয়াউর রহমান। দুই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।
জামির মোল্লা বলেছেন, “রাজ্যে শ্রমিকদের কোন নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা নেই। সরকারের কাছে শ্রমিকদের প্রাণের কোন দাম নেই। তাই অবহেলার শিকার হয়েছেন ৩ শ্রমিক। সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’’
শনিবার রাতেই এনআরএস হাসপাতালে পৌঁছেছেন পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ইসমাইল হক। রবিবার মর্গের বাইরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন ডিওয়াইএফআই রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জি, সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ মর্গে ময়নাতদন্তের পর সোমবার রাতে সুমন সর্দারের শকবাহী শকট এসে পৌঁছায় তাঁর অতি প্রিয় ন্যাজাট ৫নং পাড়ার উঠানে। ঘড়িতে তখন সময় রাত নটা। এ যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে দীনমজুর পরিবারের মাথায়। পরিবার পরিজন প্রতিবেশীদের বুকফাটা কান্নায় মোড়া ৫নং পাড়া কার্যতঃ ভেঙে পড়েছে তাদের প্রিয় সুমনকে শেষবারের মতো দেখতে। বৃদ্ধ বাবা দয়াল সর্দার মা সাজোবালা সর্দার, স্ত্রী সোনামণি বাকরুদ্ধ।বার বছরের ঈশানি,নয় বছরের ঈশিতা,ছয় বছরের ঐশানী বাবার মৃতদেহের উপর পড়ে অকূল নয়নে কেঁদে চলেছে। ২ বছরের অমৃতা তখন অবাক বিস্ময়ে ঠাকুমার কোলে। যাবতীয় আশা ভরসা স্বপ্ন এক লহমায় কেড়ে নিয়েছে বানতলার লেদার কমপ্লেক্সের ম্যানহোল। আদিবাসী সম্প্রদায়ের আচার অনুযায়ী সুমনকে হলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে নতুন বস্ত্র পরিয়ে শেষ বিদায় জানাতে স্হানীয়রা রওনা দেয় বয়ারমারি কুকরেখালি শিবরাম সর্দার স্মৃতি শ্মশানে। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
এদিকে এদিন সকালে পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চ সন্দেশখালি-১নং ব্লক কমিটির পক্ষ মঞ্চের নেতা বলরাম সরদার,অমর মাহাতো,অনুপম সর্দার যান মৃত শ্রমিক সুমন সর্দারের বাড়িতে। কথা বলেন পরিবারের সাথে।পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। সেই সারা সরকারিভাবে যে ১০লক্ষ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে তা যত দ্রুত তাঁর পরিবার পায় তার জন্য সংগঠনের পক্ষ চেষ্টা করা হবে।এছাড়াও সংগঠনের পক্ষ আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে দাবি তোলা হয় সুমন সর্দারের পরিবারে কাউকে সরকারি কাজ দেওয়ার। তাহলে চারটি শিশু কন্যাকে নিয়ে দয়াল সর্দার সাজোবালা সর্দার ও সোনামণিরা ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। শিশু কন্যারা তাদের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে।
এর পাশাপাশি এদিন মঞ্চের অন্যতম নেতা বলরাম সর্দারের পুত্রবধূ ইউনিস ধর সর্দার মৃত সুমন সর্দারের একটি কন্যা সন্তানের পড়াশুনা সহ সমস্ত দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় সুমনের পরিবারকে।
Comments :0