প্রতীম দে
‘‘সিবিআইয়ের নাম শুনলে এখন আর কেউ ভয় পায় না।’’ এই মন্তব্য কয়েকদিন আগে এজলাসে বসে করেছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি।
নিয়োগ দুর্নীতি কান্ডে সিবিআই এবং ইডি’র মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ঢিলেমিতে ক্ষোভ আর চেপে রাখতে পারেননি বিচারপতি। আদালতের নির্দেশে নিয়োগ দুর্নীতি কান্ডে তদন্ত করছে সিবিআই এবং ইডি। গত বছর জুলাইয়ে এই গ্রেপ্তার হন তৃণমূলের মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি। তারপর একে একে কুন্তল ঘোষ, সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র, মানিক ভট্টাচার্য। শিক্ষা দপ্তরের একাধিক কর্তা জেলে। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও আসল ‘মাথা’-কে গ্রেপ্তার করতে পারেনি দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, বলছে আদালতই।
সিবিআই এখনও পর্যন্ত চার্জশিট দিতে পারেনি। তদন্তের গাফিলতির অভিযোগ তুলে বিচারপতি অমৃতা সিনহা এবং অভিজিৎ গাঙ্গুলি সিবিআই এবং ইডি’র তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন। আদালত অভিযোগ তুলেছে তথ্য গোপন করার। এই দুর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়েছে ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’।
‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’-র ডিরেক্টর অভিষেক ব্যানার্জি তৃণমূলের সাংসদ। হাইকোর্ট বলেছিল অভিষেক সহ সংস্থার সব ডিরেক্টরদের সম্পত্তির হিসাব জমা দিতে হবে। ইডি যে তথ্য জমা দিল তাতে অভিষেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের উল্লেখ নেই! বিচারপতি সিনহা বললেন, ‘‘তিনি একজন সাংসদ। তাঁর কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই? সাংসদের বেতন কোথায় যায়?’’
২৫ সেপ্টেম্বর এনিয়ে আদালতের তীব্র ভর্ৎসনার মুখে পড়েন ইডি’র আধিকারিকরা। বিচারপতি অমৃতা সিনহা বলেন, ‘‘আপনারা (ইডি) কি তথ্য আড়াল করার চেষ্টা করছেন? একজন সাংসদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁর বাড়ির ঠিকানা নেই। তাহলে কীসের তদন্ত হচ্ছে? আপনাদের দেওয়া রিপোর্টে অভিষেকের নামে কেবল তিনটি বিমা আছে বলে জানানো হয়েছে। এই রিপোর্ট কি মেনে নেওয়া যায়?’’
২৯ সেপ্টেম্বর ইডি’র তদন্তকারী আধিকারিক মিথিলেশ মিশ্রকে সরানোর নির্দেশ দিতে হলো কলকাতা হাইকোর্টকে। সিপিআই(এম) প্রশ্ন তুলেছে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে। বলেছে, কার নির্দেশে তদন্ত আটকে রেখেছে দুই কেন্দ্রীয় সংস্থা।
ইডি’র অফিসারকে আদালতে যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তা থেকে বোঝা যাবে তদন্তের গতিবিধি। হাইকোর্ট বলেছে, ‘‘ লিপস অ্যান বাউন্ডস’র সিইও’র ব্যাঙ্ক আকাউন্ট না থাকলে কোম্পানি চালান কী করে? এই সংস্থাতে কীভাবে টাকা আসে? কীভাবে ব্যবসা হয়? আয়ের উৎস কী? এসব কিছুই এই রিপোর্টে উল্লেখ নেই। তাঁর বাড়ির ঠিকানা কী? ১৮৮এ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে কে থাকেন? সে কথারও কোনও উল্লেখ নেই।’’
এই সংস্থার ডিরেক্টরদের সম্পত্তির মধ্যে কারুর নামে ওই বাড়িটি আছে কিনা তাও রিপোর্টে উল্লেখ নেই। ফলে এই রিপোর্টে তদন্তের কোনও ছবি পাওয়া যাচ্ছে না। একবারে দায়সারা তদন্ত এবং তার রিপোর্ট।
নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিষেকের সংস্থার কথা স্পষ্ট বলেন ইডি’র হেপাজতে থাকা সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। ‘কালিঘাটের কাকু’ প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছিলেন, ‘‘আমার মালিক অভিষেক ব্যানার্জি। তাঁকে কেউ ছুঁতে পারবে না।’’
‘কাকু’ এই কথা বলেছেন ফেব্রুয়ারি মাসে। আজ অক্টোবর। ঠিক এই সময়কালে তিনবার জেরা করা হয়ে গেলো অভিষেককে। প্রতিবার তিনি যাচ্ছেন আট ঘন্টা, নয় ঘন্টা পর বাইরে আসছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করছেন। আর বলছেন কত ডাকবে ডাকুক। তিনি এও দাবি করেছেন যে তার সংস্থা নিয়োগ দুর্নীতির একটা টাকাও নেননি।
শুধু নিয়োগ দুর্নীতি নয়। রাজ্যের একাধিক দুর্নীতির তদন্ত করছে সিবিআই। যেমন, সারদা কেলেঙ্কারি। ২০১৩ সালে সারদায় টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হন বহু খেটে খাওয়া মানুষ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত শুরু করে সিবিআই। সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী এবং কংগ্রেস নেতা আন্দুল মান্নান সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আদায় করে আনেন। যদিও সেই সময় রাজ্য সরকার টাকা খরচ করে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছিল।
দশ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত সারদায় যারা আসল দোষী তারা শাস্তি পায়নি। তৃণমূল নেতা সুদীপ ব্যানার্জি, মদন মিত্র, কুণাল ঘোষরা এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হলেও এখন জামিনে। নারদা, রোজভ্যালি তদন্তেরও একই অবস্থা।
গরু পাচারের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হয়েছেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তার মেয়ে সুকন্যাও জেলে। এক বছর হতে চলেছে। আর কোন নতুন অগ্রগতি নেই। মানিক ভট্টাচার্য্যের স্ত্রী জামিন পেয়েছেন।
হাজার দিনের কাছাকাছি রাস্তায় বসে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন যোগ্য বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা। তাঁদের দাবি ঘুষ দিতে পারেননি বলে চাকরি পাননি। আর রাজ্যের মন্ত্রী পরেশ অধিকারির মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারি পিছন থেকে সামনে এসেছেন। আদালতের নির্দেশে চাকরি গিয়েছে তাঁর। দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থা যে ভাবে তদন্ত চালাচ্ছে তাতে যোগ্যরা চাকরি কবে এবং দোষীরা কবে শাস্তি পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আন্দোলনরত চাকরি প্রার্থীদের একটাই দাবি, দোষীদের শাস্তি চাই। বয়স পেরিয়ে গেলে তাঁরা আর চাকরি পাবেন না। কিন্তু কে তাদের কথা শুনছে?
Comments :0