STATE LOVE SUICIDE

মমতা-শাসনে— অভাবে, দেনার দায়ে নয়, প্রেমের জ্বালায় আত্মহত্যা বেশি!

রাজ্য

 

প্রেম বড় বালাই। প্রবল সঙ্কট বিয়ে নিয়ে ঝামেলা। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কও এক মারাত্মক বিপদ হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে। আর এই ধরনের বিপদে দিশাহারা মানুষ আত্মহত্যা করে ফেলছেন। কিন্তু সংসারে অভাব, বেকারি, মহাজনের সুদ-আসলের ধাক্কা সেই রাজ্যের মানুষকে টলাতে পারছে না। রাজ্যবাসীর মনস্তত্ব সম্পর্কে এমনই অদ্ভুত রিপোর্ট তুলে ধরেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। 

প্রসঙ্গ ‘২০২২-র আত্মহত্যা সংক্রান্ত’ পুলিশের রিপোর্ট। রাজ্যওয়াড়ি যে রিপোর্ট প্রায় মাস তিনেক দেরি হলেও প্রকাশ করেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো(এনসিআরবি)। এনসিআরবি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীন। সেই মন্ত্রকের দায়িত্বে বিজেপি’র বড় নেতা অমিত শাহ। তাঁরই মন্ত্রক মমতা ব্যানার্জি সরকারের আত্মহত্যা সংক্রান্ত আশ্চর্যজনক তথ্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। বেমালুম তা ছাপিয়ে দিয়েছে। 

কেমন আজগুবি তথ্য রাজ্য দিয়েছে? ২০২২-এ রাজ্যে ১২,৬৬৯জন আত্মহত্যা করেছেন বলে তৃণমূল সরকারের দাবি। তার মধ্যে ‘অজানা’ কারণে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন পশ্চিমবঙ্গে। সেই সংখ্যা ৩৪৩৬। আর ‘আদার্স’ কিংবা অনির্দিষ্ট কারণে আত্মঘাতীর সংখ্যা ৪০৮৮। অর্থাৎ প্রায় ৬০% আত্মহত্যার কারণই পুলিশ চিহ্নিত করেনি। অভিযোগ, আসলে পুলিশ আত্মহত্যার কারণ জানায়নি। এর বড় অংশই অভাবের কারণে, ফসলের দাম না পেয়ে, মহাজনের ঋণ-সুদের চাপে, কাজ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

রিপোর্ট জানাচ্ছে, আত্মহত্যার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ দেশে পঞ্চম। ২০২২-এ পশ্চিমবঙ্গের ১২,৬৬৯জন আত্মঘাতী হয়েছেন। মহারাষ্ট্র, মধ্য প্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাডুর পরই স্থান পশ্চিমবঙ্গের। এই সময়ে কলকাতায় ২৮৩ জন আত্মঘাতী হয়েছেন। রাজ্যের আত্মঘাতীদের মধ্যে ৪৬৪৪ জন মহিলা। আত্মঘাতী মহিলাদের সংখ্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয়। তামিলনাডু, মধ্য প্রদেশের পরেই পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও পুলিশের চালাকি অথবা ব্যর্থতা। ২৫৮৬ জন মহিলার আত্মহত্যার কারণই পুলিশ চিহ্নিত করেনি। অর্থাৎ প্রায় ৫৬% মহিলার আত্মহত্যার কারণই মমতা ব্যানার্জির সরকার খুঁজে বের করেনি বলে নিজেরাই জানিয়েছে।

সেই সব তথ্য চেপে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীর আত্মহত্যা-জনিত অপরাধের যে ছবি মমতা ব্যানার্জি তুলে ধরতে চেয়েছেন, তা বাস্তবকে ঢাকার চেষ্টাই শুধু নয়, বিভ্রান্তিকর।

কী দেখানো হয়েছে রিপোর্টে?

আত্মঘাতীদের মধ্যে কৃষক পরিবারের কেউ নেই। কোনও কারণেই কৃষক পরিবারের কেউ আত্মহত্যা করেননি। আত্মঘাতী হননি কোনও খেতমজুরও। যেহেতু কোনও কারণেই কোনও কৃষক, খেতমজুর আত্মহত্যা করেননি, তাই রিপোর্ট জানাচ্ছে, ঋণের চাপে কেউ আত্মহত্যা করেননি। দেশের দেনার কারণে ৬৯৯৬ জন আত্মঘাতী হলেও পশ্চিমবঙ্গের একজনও সেই তালিকায় নেই। যদিও মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যেও ঋণের চাপে আত্মহত্যার ঘটনা আছে। রাজ্যের কৃষকদের অনেকেই ব্যাঙ্কের ঋণ এবং সরকারি সহায়তা না পেয়ে মহাজনের ঋণের উপর নির্ভরশীল। প্রতিবছরই তাদের একাংশ মহাজনের ঋণের চাপে দিশাহারা হয়ে আত্মহত্যা করেন। শুধু কৃষকরাই ধার করেন, এমন নয়। শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছোট ব্যবসায়ীরাও ধার করেন মহাজনের থেকে। যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কারণে এবং রাজ্য সরকারের অপদার্থতায় রাজ্যে ব্যাঙ্কের ঋণের পরিমাণ লাগাতার কমছে, ফলে বেসরকারি সংস্থা, মহাজন, মাইক্রো ফিনান্সের উপর নির্ভরশীল রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ। এই ধরনের বেসরকারি সুদের কারবারি আবার স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের ফান্ড-ম্যানেজার। তাই কৌশলে ঋণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা চেপে দিয়ে মহাজনী কারবারের ভয়ঙ্কর অত্যাচার আড়াল করেছেন মমতা ব্যানার্জি। 

রাজ্য সরকার দাবি করেছে কাজ না পেয়ে মাত্র ১২জন আত্মহত্যা করেছেন রাজ্যের। যদিও এই প্রশ্নে রাজ্যের সমাজবিজ্ঞানীদের একজনের বক্তব্য,‘‘কোনও সন্দেহ নেই সরকার তথ্য গোপন করেছে। তবে একইসঙ্গে আর একটি সত্যও আছে এর পিছনে। যেহেতু রাজ্যে কাজ পাওয়ার কোনও আশাই আর কর্মপ্রার্থীরা রাখেন না, অনেকেই যে রাজ্যে পারছেন চলে যাচ্ছেন কাজের জন্য, ফলে এখানে কাজ না পেয়ে আত্মহত্যা করার জন্যও কেউ বসে থাকছেন না।’’ তবে রাজ্য সরকার জানিয়নেছে, কৃষক, খেতমজুর আত্মঘাতী না হলেও দিনমজুর অনেকে আত্মহত্যা করেছেন একবছরে। আত্মঘাতীদের মধ্যে ৯৮৮জন দিনমজুর। তাঁদের মধ্যে ৫৫জন মহিলা। দারিদ্রের কারণে এই রাজ্যে কেউ আত্মঘাতী হননি। দেশের যে রাজ্যে অর্থনীতি সবচেয়ে ভালো, সেই কেরালা সরকারও জানিয়েছে অভাবের কারণে ২০২২-এ সেখানে ৪ জন আত্মঘাতী হয়েছেন। গোয়ার মত একটি ছোট এলাকাতেও অভাবে মৃত্যুর ঘটনা আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে? না — শূন্য।

আত্মহত্যার সামাজিক কারণের যে রেখচিত্র ফুটে উঠেছে, তা জানাচ্ছে পণের কারণে আত্মহত্যা করা মহিলাদের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয়। একবছরে পণের কারণে রাজ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১২৮ জন। সামনে শুধু উত্তর প্রদেশ এবং মধ্য প্রদেশ। তবে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের টানাপোড়েনে মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ দেশে সবার আগে, এমনটাই দাবি মমতা ব্যানার্জির সরকারের। একবছরে ১৫১ জন এই কারণে আত্মহত্যা করেছেন বলে সরকার জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিয়ে নিয়ে ঝামেলাও পশ্চিমবঙ্গের নারী, পুরুষের কাছে বিরাট সমস্যা। অন্তত মমতা ব্যানার্জি সরকারের দাবি তাই। একবছরে পশ্চিমবঙ্গে বিয়ে নিয়ে গোলমালে আত্মঘাতী হয়েছেন ৩০২ জন। যার ধারে কাছে উত্তর প্রদেশ(২৬১) ছাড়া কোনও রাজ্য নেই। আবার প্রেমের কারণে আত্মহত্যাতেও পশ্চিমবঙ্গ দেশে শীর্ষে। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, একবছরে রাজ্যে প্রেম-সঙ্কটে আত্মঘাতী হয়েছেন ৭৫৩জন। তাঁদের মধ্যে ৪২০জন পুরুষ। বাকিরা মহিলা।

নেশার কারণেও পশ্চিমবঙ্গে কেউ আত্মঘাতী হননি বলে রাজ্যের দাবি। এই ক্ষেত্রে শুধু মণিপুর ছাড়া দেশের সব রাজ্যেই নেশার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা আছে।

Comments :0

Login to leave a comment