EDITORIAL

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় গুরুতর আঘাত

জাতীয় সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial

ক্ষমতায় আসার আগে আরএসএস-বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলে সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ ক ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বা অধিকার বাতিল করে দেবে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতা দখল করলেও সেই প্রতিশ্রুতি পালনের দুঃসাহস দেখাতে পারেনি পরবর্তী ভোটে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসে সঙ্গে সঙ্গেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কার্যত জোরজবরদস্তি বিল পাশ করিয়ে বাতিল করা হলো ৩৭০ ধারা। বিল পাশের এই মুহূর্তেও সময় নষ্ট না করে তাতে চোখ বুঝে স্বাক্ষর করে দিলেন রাষ্ট্রপতি। তার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করা সেনা-আধা সেনাদের উড়িয়ে আনা হয় জম্মু-কাশ্মীরে। গোটা রাজ্যকে সেনা জওয়ানে মুড়ে দিয়ে কার্যত জুন্টা শাসনের চেহারা দেওয়া হয়। তার অনেক আগেই অবশ্য নির্বাচিত সরকার ভেঙে দিয়ে চালু করা রাষ্ট্রপতি শাসন তথা কেন্দ্রীয় শাসন। জম্মু-কাশ্মীরকে পুরোপুরি মোদী-শাহদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে এনে, বিরোধীদের জেল বা গৃহবন্দি করে, মানুষের জাতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার এমনকি মৌলিক অধিকারগুলিও কেড়ে নেওয়া হয়। বন্দিশালায় রূপান্তরিত সেই কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত করা হয়। উপরন্তু তাকে দ্বিধাবিভক্ত দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়।
মোদী সরকারের এহেন একতরলা সিদ্ধান্তের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা রুজু হয়। কিন্তু মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সেই মামলা পড়ে থাকে। শুনানির কোনও উদ্যোগ নেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। আর সেই দীর্ঘ অবসরে মোদী সরকার একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে কাশ্মীরবাসীদের জীবন-জীবিকা ও ভবিষ্যতের বিপন্ন করে তুলতে থাকে। কাশ্মীরের চিরাচরিত ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে জনবিন্যাসকে বদলে ফেলার সচেতন প্রয়াস চলতে থাকে। কাশ্মীরের নাগরিকদের উপর আরএসএস-বিজেপি’র পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে বহিরাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আসন পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ছকও কষা হয়। এইভাবে চার বছর ধরে ধাপে ধাপে কাশ্মীরকে হিন্দুত্ববাদীদের অনেকটা কবজায় আনার পর সুপ্রিম কোর্ট মামলার শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় এবং দ্রুত শুনানি শেষ করে। তবে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর রায় ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ।
তাতে জম্মু-কাশ্মীরের বি‍শেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে ৩৭০ বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং রাজ্যকে ভাগ করার সিদ্ধান্তকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায়ের ফলে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান ভিত্তি সেটা‍‌ই গুরুতর প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সংবিধানের ৩নং ধারা অনুযায়ী কোনও রাজ্যের পুনর্গঠন সংক্রান্ত বিল রাষ্ট্রপতির কাছে এলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের নির্বাচিত আইনসভার মতামতের জন্য তিনি পাঠাবেন। এক্ষেত্রে রাজ্য বিধানসভা সরাসরি এড়িয়ে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত রাজ্যপালকে নির্বাচিত আইনসভার বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই রায় কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তারা খুশিমত যেকোন রাজ্যকে রাষ্ট্রপতি শাসনে এনে তার বিভাজন, এলাকা বদল, সীমানা বদল ইত্যাদি করতে পারবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিতটাই নড়বড়ে করে দিতে পারে। নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভার অধিকার খর্ব করে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের পরিধি প্রশস্ত হবে।


 

Comments :0

Login to leave a comment