NO CONFIDENCE PARLIAMENT

নীরব প্রধানমন্ত্রীকে সরব করতে এই প্রথম সংসদে অনাস্থা

জাতীয়

NO CONFIDENCE PARLIAMENT

প্রতীম দে

সাতাশ বার অনাস্থা প্রস্তাবের সাক্ষী থেকেছে দেশের সংসদ। কিন্তু এবারের অনাস্থা অনন্য।

জওহরলাল নেহরু থেকে মনমোহন সিং, সব প্রধানমন্ত্রীকেই কোন না কোন বিষয় নিয়ে অনাস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু অতীতে কখনও নীরব প্রধানমন্ত্রীকে সরব করাতে অনাস্থা হয়নি। তা হচ্ছে এবার। 

বাদল অধিবেশনের প্রথমদিন থেকেই বিরোধীরা লোকসভায় এবং রাজ্যসভায় মণিপুর নিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সরব। তার ভিত্তিতে বিশদ আলোচনার দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। সিপিআই(এম) সহ বিরোধীরা বলছেন, তিন মাস ধরে জ্বলছে মণিপুর। গোটা উত্তর-পুর্ব ভারত আগুনের ওপর দাঁড়িয়ে। টানা চুপ থেকেছেন নরেন্দ্র মোদী। আমেরিকা থেকে ফ্রান্স সফর বা ভারতের অন্যত্র বিভিন্ন বিষয়েই যদিও বলছেন তিনি। বাদ থেকেছে কেবল মণিপুর। 

গত সপ্তাহেই মণিপুরে নারীদের ওপর বর্বরতার ভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ঘটনা যদিও মে’র। প্রধানমন্ত্রী চুপ। বাদল অধিবেশনের প্রথম দিন মুখ খুলতে হলো তাঁকে, কিন্তু সংসদের অধিবেশনে নয়। বাইরে মণিপুরের জন্য বরাদ্দ করলেন কয়েকটি মাত্র বাক্য। বিরোধীরা বললেন, এই পরিস্থিতিতে সংসদেই বিবৃতি দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। রাজ্যে এবং কেন্দ্রে সরকার বিজেপি’র। কেন্দ্রের সরকার কী করেছে বলতে হবে। তার ওপর বিশদে অধিবেশনে হবে আলোচনা। 

সরকার রাজি নয় বিশদ আলোচনায়। প্রধানমন্ত্রীও বিবৃতি দিতে নারাজ। স্বল্প মেয়াদী আলোচনার বাইরে কিছু হবে না, বিরোধীদের নোটিশ খারিজ করেছেন লোকসভার স্পিকার এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। ফলে বাধ্য হয়ে আনতে হয়েছে অনাস্থা প্রস্তাব। সংখ্যার জোর প্রমাণের জন্য নয়। সংবিধানসম্মত বোঝাপড়া মনে করিয়ে দিতে যে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য সরকার। 

ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে এই প্রথম দেশের কোনও প্রান্তে অশান্তি নিয়ে সরকারের কী মনোভাব প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে জানার জন্য অনাস্থা প্রস্তাব আনতে বাধ্য হচ্ছেন বিরোধীরা।

সংসদের নিয়ম অনুযায়ী ১৯৮ নম্বর রুল জারি করে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হয়। সাধারণত বিরোধীদের পক্ষ থেকেই এই অনাস্থা আনা হয়। এবার যেমন কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ এনেছেন। তবে শুধু অনাস্থা প্রস্তাব আনলেই হবে না। প্রস্তাবের পক্ষে ৫০ জন সাংসদের সমর্থন দরকার। বর্তমান লোকসভার যা চিত্র সেই সংখ্যা কংগ্রেসের রয়েছে। এছাড়া এই অনাস্থায় সমর্থন জানাচ্ছে সিপিআই(এম)সিপিআইয়ের মতো ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের একাধিক বিজেপি বিরোধী দল।

এর আগে সংসদে কতবার এসেছে অনাস্থা? সংক্ষেপে দেওয়া রইল বিভিন্ন সময়ে অনাস্থা প্রস্তাবের ঘটনাক্রম।

মোট ২৭ বার অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর তর্ক বিতর্কের সাক্ষী থেকেছে লোকসভা। এর মধ্যে তিনবার সরকার পক্ষ হেরেছে। একবার ভোটাভুটি ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।

১৯৭৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। সেই সময় কোন ভোট হয়নি। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনা হয়। ভোটাভুটি শুরু হওয়ার আগেই নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন দেশাই।

১৯৯০১৯৯৭১৯৯৯ সালে অনাস্থায় হেরেছিল সরকার পক্ষ।

আগস্ট ১৯৬৩ – প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয় লোকসভায়। জওহরলাল নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন কংগ্রেস সাংসদ আচার্য কৃপালানি। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধে ভারতের হারের পর এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় সরকারের বিরুদ্ধে। সেই অনাস্থায় জিতে যায় নেহরু সরকার। ৩৪৭ ভোট পড়ে সরকারের সমর্থনে ৬২টি ভোট যায় বিপক্ষে। তবে সেই সময় এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলেছিল। চারদিন টানা আলোচনা চলে।

সেপ্টেম্বর ১৯৬৪  প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। অনাস্থা আনেন এনসি চ্যাটার্জি। এখানেও শেষ হাসি হাসে সরকার পক্ষ। ফলাফল সরকারের পক্ষে ৩০৭। বিপক্ষে ৫০

মার্চ ১৯৬৫ – আবার লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা। এবার এসএন দ্বিবেদী উত্থাপক। ৩১৫টি ভোট যায় সরকারের পক্ষে।

আগস্ট ১৯৬৫ – ফের অনাস্থার মুখোমুখি শাস্ত্রী সরকার। স্বতন্ত্র পার্টির সাংসদ এমআর মাসানি অনাস্থা আনেন। মাত্র ৬৬ জন সাংসদ অনাস্থার পক্ষে ভোট দেন।

আগস্ট ১৯৬৬ – প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী যেমন তিনি ঠিক তেমন ভাবে প্রথম রাজ্যসভার সাংসদ প্রধানমন্ত্রী পদে। সিপিআই সাংসদ হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জি অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। ইন্দিরা গান্ধী ২৭০ জন সাংসদের সমর্থন পান।

নভেম্বর ১৯৬৬ – জনসঙ্ঘের সাংসদ ইউএম ত্রিবেদী অনাস্থা প্রস্তাব আনেন ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পক্ষে। এবার ২৩৫ জন সাংসদ সমর্থন দেয় কংগ্রেসকে।

নভেম্বর ১৯৬৭– মধু লিমায়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনে সরকারের বিরুদ্ধে। ২১৫টি ভোট পেয়ে সরকার টিকিয়ে রাখেন ইন্দিরা গান্ধী।

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ – বলরাজ মাধোক অনাস্থা আনেন। সেই সময়ও ২১৫ জনের সমর্থন থাকে ইন্দিরা সরকারের প্রতি। 

নভেম্বর ১৯৬৮ – ভারতীয় জনসঙ্ঘের সাংসদ কানোয়াল লাল গুপ্ত ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। ২২২ টি ভোট পড়ে ইন্দিরার পক্ষে। সরকার টিকে যায়।

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ – আবার অনাস্থা ইন্দিরার বিরুদ্ধে। এবার আনলেন সিপিআই(এম) সাংসদ পি রামমূর্তি। জিতে যায় সরকার পক্ষ।

জুলাই ১৯৭০ – মধু লিমায়ে আবার অনাস্থা আনলেন। সরকার ফেলতে পারলেন না। কিন্তু ১৩৭ জন সাংসদ তার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলচাপ ছিল ইন্দিরা গান্ধীর ওপর।

ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি এনেছিলেন তিনি হলে জ্যাোতির্ময় বসু। সিপিআই(এম) সাংসদ। চার বার অনাস্থা প্রস্তাব আনেন তিনি। 

নভেম্বর ১৯৭৩ – প্রথম অনাস্থা আনলেন জ্যাোতির্ময় বসু। ৫৪ জন সাংসদ সমর্থন করেন।

মে ১৯৭৪ – আবার অনাস্থা আনলেন বসু। ধ্বনি ভোটে জিতে যান ইন্দিরা গান্ধী।

জুলাই ১৯৭৪ – বসুর আনা অনাস্থা প্রস্তাব টেকেনি।

মে ১৯৭৫ – জরুরি অবস্থা ঘোষণা হওয়ার কয়েক মাস আগে ফের ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন জ্যোতির্ময় বসু। ধ্বনি ভোটে আবার জয়ী হয় সরকার পক্ষ।

মার্চ ১৯৭৬ – ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন অটল বিহারী বাজপায়ী। সেবার সরকার টিকে থাকলেও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেবার অনাস্থার পক্ষে ১৬২ জন সাংসদ সমর্থন জানান।

মে ১৯৭৮ – মোরারজি দেশাই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা সিএম স্টিফেন। ধ্বনি ভোটে সরকার টিকে যায়।

জুলাই ১৯৭৯ – দেশাই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন ওয়াই বি চৌহান। লোকসভায় এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর পদত্যাগ করেন দেশাই। প্রথম কোনও ভোটাভুটি ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন।

মে ১৯৮১ – প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। অনাস্থা প্রস্তাব আনেন জর্জ ফার্নান্ডেজ। আবার জয়ী হন ইন্দিরা।

সেপ্টেম্বর ১৯৮১ – ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন সিপিআই(এম) সাংসদ সমর মুখার্জি। জয়ী হয় সরকার পক্ষ। 

আগস্ট ১৯৮২ – ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা হেমবতী নন্দন বহুগুনা। জরুরি অবস্থার বিরোধীতা করে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ছিলেন। তবে সেবারও টিকে যান ইন্দিরা।

ডিসেম্বর ১৯৮৭ – প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। অনাস্থা আনেন সি মাধব রেড্ডি। ধ্বনি ভোটে জয়ী হয় কংগ্রেস সরকার।

নভেম্বর ১৯৯০ – রাম মন্দির ইসুতে ভিপি সিংহ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় বিজেপি। অনাস্থা ভোটে হেরে যায় সরকার।

জুলাই ১৯৯২ – নরসিমা রাও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন বিজেপি সাংসদ যশবন্ত সিনহা। সেবার লড়াই হয়েছিল হাড্ডাহাড্ডি। ২২৫ জন সাংসদ অনাস্থার পক্ষে ভোট দেন। ২৭১ জন প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। 

ডিসেম্বর ১৯৯২ – নরসিমা রাও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। ১১১ জন সাংসদ তার আনা প্রস্তাবকে সমর্থন করে। 

জুলাই ১৯৯৩ – তৃতীয় বার নরসিমা রাও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট হয়। সেবারও লড়াই হয়েছিল হাড্ডাহাড্ডি। প্রস্তাবকে সমর্থন করেন ২৫১ জন। বিরোধিতা করেন ২৬৫ জন।

এপ্রিল ১৯৯৭   দশ মাসের মধ্যে পড়ে যায় দেবেগৌড়া সরকার। লোকসভায় অনাস্থা ভোটে হেরে যায় সরকার। অনাস্থার পক্ষে ভোট ছিল ২৯২বিপক্ষে ১৫৮।

এপ্রিল ১৯৯৯ – এডিএমকে বাজপেয়ী সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ায় লোকসভায় আস্থা ভোট হয়। সেবার এক ভোটের জন্য সরকার হেরে যান বাজপেয়ী।

আগস্ট ২০০৩ – বাজপেয়ী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন সোনিয়া গান্ধী। ২১ ঘন্টা সংসদে আলোচনা চলে এই প্রস্তাবের ওপর। সেবার অনাস্থায় হেরে যায় কংগ্রেস।

জুলাই ২০০৮ – পরমানু চুক্তির বিরোধিতা করে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেন বামপন্থীরা। সেবার হয় আস্থা ভোট। চাপে পড়লেও কোনও মতে সরকার টিকে যায়।

জুলাই ২০১৮ – মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন টিডিপি সাংসদ শ্রীনিবাস কেসিনেনি। ১১ ঘন্টা আলোচনা হয় লোকসভায়। অনাস্থা ভোটে জিতে যায় মোদী সরকার।

Comments :0

Login to leave a comment