Post editorial

প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়

উত্তর সম্পাদকীয়​

অপূর্ব চ্যাটার্জি

২৪ তম পার্টি কংগ্রেসকে সামনে রেখে মধ্যবর্তী পার্টি কমিটিগুলির সম্মেলন প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যে রাজ্যে জেলা সম্মেলনগুলি শুরু হয়েছে। গত তিন বছরে ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত রাজনৈতিক লাইনের প্রয়োগে- কাজের অভিজ্ঞতার পর্যালোচনার নিরিখে, আগামীতে রাজ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তনের লক্ষ্যে দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি চলছে। 
কোন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে রাজ্যের মানুষ? সারা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির আধিপত্য কায়েম রাখতে, নয়া উদারনীতির প্রয়োগের কারণে শ্রমজীবী জনতার উপর শোষণ আরও তীব্র হয়েছে। লগ্নি পুঁজির অবাধ লুণ্ঠন বহু দেশের আর্থিক ও রাজকোষের পরিস্থিতিকে এলোমেলো ও দুর্বল করে ফেলেছে। নয়া উদারবাদের সংকটের কারণে এবং তারই ফলশ্রুতিতে বারে বারে ব্যয় সংকোচনের পদ্ধতি প্রয়োগে উন্নত দেশের সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শ্রমজীবী জনগণকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। স্বভাবতই দেশের এবং এ রাজ্যের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, খেতমজুর, বেকার, মধ্যবিত্ত কেউই সুখে নেই— এক অনিশ্চিত, উত্তেজনাময় জীবন কাটাতে হচ্ছে। কাজ না পেলে, ফসলের উচিত মূল্য না পেলে কিংবা মজুরি না বাড়লে, স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে সঠিক চিকিৎসা না পেলে জীবনে কি অন্ধকার নেমে আসে তা এ সময় রাজ্যের মানুষ টের পাচ্ছেন। আজ কি চেহারা রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের? কৃষি ক্ষেত্রের? শুধু পূর্ব বর্ধমান জেলাতেই গত ১০ বছরে প্রায় ২০০ জন কৃষক, খেতমজুর আত্মহত্যা করেছে। ‘শস্য গোলা’র এই জেলায় কৃষি ব্যবস্থার ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায় ইপিডব্লিউ পত্রিকায় (৪ জুন'২২) 'কন্ডিশনস অব ফার্মার্স ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল' গবেষণাপত্রে। দেখা যাচ্ছে, এখন পূর্ব বর্ধমানে কৃষকদের প্রায় ৭৫ শতাংশ দরিদ্র কৃষক যাদের দৈনিক মাথাপিছু ৪৭ টাকার বেশি খরচ করার সামর্থ্য নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত নাবার্ডের তথ্য অনুসারে, আমাদের রাজ্যে কৃষিজীবী পরিবারের মাসিক আয় ১১,০৪৫৬ টাকা, দেশের মধ্যে রাজ্য ২৪ নম্বরে। দক্ষিণবঙ্গের চাষিদের সব রকম প্রশিক্ষণের জন্য বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে কৃষি বিকাশ কেন্দ্র (পোশাকি নাম ‘মাটিতীর্থ’) ৬০০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়েছিল। এখন সেটি জঙ্গল আর পশু খামার ছাড়া আর কিছু না। গত বছর ভাতারের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন- ‘এবার ধান সংগ্রহ কম, প্রয়োজনে গাড়ি পাঠিয়ে ধান মেপে নিয়ে নিন।’ রাজ্যের চাষিরা নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন এসব তাদের সাথে তঞ্চকতা ছাড়া আর কিছু না। এবারেও খোলা বাজারে নতুন ধানের দামের সাথে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের স্বল্প পার্থক্য থাকায় এবং নামমাত্র উৎসাহ ভাতা দেওয়ার জন্য চাষিরা কিষান মান্ডি বা ধান্য ক্রয় কেন্দ্রে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। রেজিস্ট্রেশন, ধান বিক্রির তারিখ নেওয়া, বিক্রি করতে আসার খরচ বৃদ্ধি, খাদ বাদ দেওয়া, প্রয়োজনীয় মূল্য না পাওয়ার কারণে চাষিরা কৃষক মান্ডিতে গিয়ে ধান বিক্রি করতে চাইছেন না। 
মোদী- মমতার কথা মতো কৃষকের আয় দ্বিগুণ-তিনগুণ হওয়া তো অনেক দূরের কথা— ধান, আলু, তৈলবীজ প্রভৃতির উৎপাদন খরচও আসছে না। পাঞ্জাবের বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ, বিদ্যুৎ, ডিজেল ইত্যাদির দাম বৃদ্ধিতে আলু চাষের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। চাষে লাভ মিলবে কিনা ঘোর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। লোকসান ও সংকটের কারণে অনেকেই কৃষিকাজ থেকে দূরে সরে যেতে চাইছেন। ৩ বছর আগে পূর্ব বর্ধমান জেলায় প্রায় ৫০০টি রাইস মিল ছিল, এখন কমে হয়েছে ২৬২। কোল্ডস্টোরেজও ১০৩ থেকে কমে হয়েছে ৮৮। ইতিমধ্যে পেপসি, আদানি আলু, ধান-চাল ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। যে উৎপাদক চাষি মাঠে ৬/৮ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়, ফড়েদের হাত ঘুরে তা বাজারে আসার পরে সেই চাষিকেই সেটা ৩০/৪০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। জেলার অভ্যন্তরে কালনা মহকুমা সহ তাঁত শিল্প নিবিড় এলাকাগুলিতে যে অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, তা আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- এই অসহনীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে কিনা? লেনিন স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কৃষিক্ষেত্র ও গ্রামীণ প্রত্যন্ত অঞ্চলের শোষিত শ্রেণিগুলিকে বিপ্লবের মিত্র হিসাবে দৃঢ়ভাবে সংগঠিত করা দরকার। আমাদের পার্টি কর্মসূচি কৃষি বিপ্লবকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অক্ষরেখা হিসাবে গ্রহণ করেছে, যার নেতৃত্ব দেবে শ্রমিক শ্রেণি। এই উপলব্ধির মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে কেন্দ্রীয় বিষয়— গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য অর্জনের অত্যাবশ্যক হাতিয়ার হিসাবে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর মৈত্রী গঠন ও তার বিকাশের প্রয়োজনীয়তা। রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনে একে শক্তিশালী হিসাবে গড়ে তোলার কাজই এখন গুরুত্বপূর্ণ। 
অর্থনীতিবিদ্‌রা বলছেন— ভারতে যেটুকু আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে তার পুরোটাই অতিধনীদের কুক্ষিগত, তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার এবং দেশে ধনী ও দরিদ্রের আর্থিক অসাম্য সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। দেশের ঋণ, রাজস্ব ও  আর্থিক ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। টাকার দামের পতনও সর্বোচ্চ, ১ ডলার এখন ৮৫.০৪ টাকা। মোদী যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন এক ডলার ছিল প্রায় ৫৮ টাকা। মানুষের আয় ও সঞ্চয় কমছে, গৃহস্থের ঋণের বোঝা বাড়ছে। ফলত দেশের গ্রাম-শহরের অভ্যন্তরীণ বাজার ধুঁকছে। প্রত্যেকদিন জীবনযাপনের জন্য যা না হলেই নয়, সেই খাদ্যপণ্যের দাম প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। কি খাবে শ্রমজীবী মানুষ, গরিব কৃষক? এর সাথে বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস, পেট্রোপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রণে ও পছন্দমাফিক চলছে দেশের সরকার ও অর্থনীতি। ফলে কর্পোরেট ও ধনীদের বিপুল সম্পত্তি এবং মুনাফা এ সময় বেড়েছে। এদের সেবায় ব্যাপক ব্যাঙ্ক ঋণ ও কর মকুবের সাথে দেশের সম্পদ, পরিকাঠামোকে বিনা পয়সায় উপহার দেওয়া হচ্ছে। নোট বাতিল, ইলেক্টোরাল বন্ড, পিএম কেয়ার ফান্ড, নিট স্ক্যাম, আদানি শেয়ার প্রতারণা এই সবই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক আর্থিক কেলেঙ্কারি। দেশের কৃষি, শিল্প, পরিষেবা অর্থনীতির প্রধান ক্ষেত্রগুলির অবস্থা ভয়াবহ। উলটে উচ্চকণ্ঠে প্রচার হচ্ছে— জাপান, জার্মানিকে টপকে ভারত তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে, ২০৪৭ সালে উন্নত অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠবে। অথচ মাথাপিছু আয়ের নিরিখে, মানব উন্নয়ন সূচকে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আমরা একদম নিচের সারিতে। ভারতে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বছরে এখন ২৭০০ ডলারের কাছাকাছি। জাপান, আফ্রিকা, ব্রাজিল ও চীনে এক্ষেত্রে যথাক্রমে এর ১৪, ৩, ৪, ৫ গুণ বেশি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাবে উন্নত দেশ হতে হলে, মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১৪ হাজার ডলার হতে হবে। অর্থাৎ আগামী ২২বছরে ভারতকে মাথাপিছু আয় ২৭০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। তার মানে মাথাপিছু আয় বছরে ৭.৭% হারে বাড়াতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে জিডিপি বৃদ্ধির বার্ষিক হার হতে হবে সাড়ে আট থেকে দশ শতাংশ। টানা দু’দশক ধরে এই হারে বৃদ্ধি অসম্ভব। বরং চলতি আর্থিক বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার নেমে ৫.৪ শতাংশ হয়েছে। 
আজ বেকারত্ব ও আর্থিক অসাম্য সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর কারণ কি? উদারবাদী রাজনীতি সাধারণভাবে উদ্ভূত সংকটের কারণকে এড়িয়েয়ে গিয়ে সমাধানের রাস্তা খোঁজে। এই কারণেই নয়া উদারবাদ সংকটকে সংকট হিসাবে চিহ্নিত করলেও কারণ হিসাবে দায়ী করে দেশের মধ্যে বসবাসকারী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের। এদের প্রতি ঘৃণা বিভেদ-বিদ্বেষের প্রচার সংগঠিত করে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাবতীয় সমস্যার জন্য দায়ী এই সংখ্যালঘুরাই। আসলে সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণে সুসমন্বিত একটি বিকল্প উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করার অস্বীকৃতি এবং বিরোধিতা এই সংকটকে গভীরতর করছে। জনস্বার্থের ইস্যুতে সংসদে গুরুত্বপূর্ণ চর্চা এখন বন্ধ। পরিকল্পিতভাবেই সংসদের অধিবেশনের দিন কমে এখন বছরে মাত্র ৪৫-৫৫ দিন চলে। দেশের ভয়াবহ অন্ধকারের বাস্তব চিত্র ঢাকতে অসত্য ভাষণ, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ির প্যাকেজ ও মার্কেটিং হচ্ছে। পাশাপাশি আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণা এবং মেরুকরণের রাজনীতিও ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্ষতি করছে। অর্থনীতির অগ্রগতি শুধুমাত্র রাজস্ব বা মুদ্রা নীতির উপর নির্ভর করে না তা দেশে সার্বিক আস্থা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। 
ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষ নীতি, নজরদারিমূলক রাষ্ট্রকাঠামো দেশের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে তাই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল সংবিধান রক্ষা করার। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে কিছুটা ধাক্কা দেওয়া গেলেও, তারা নিজেদেরকে পুনঃসংগঠিত করতে সক্রিয়। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকে লাগাতার আক্রমণের অংশ হিসাবেই বাবাসাহেব আম্বেদকরকে নিয়ে রাজ্যসভায় অমিত শাহের অপমানজনক উক্তি। কেন বিজেপিকে আমরা প্রধান শত্রু মনে করি-তা জনগণের সামনে আরও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরার চেষ্টা চালাতেই হবে। ফ্যাসিস্টিক এই ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের রূপ কি হবে— তা নিয়ে সম্মেলনে, পার্টি কংগ্রেসে আরও চর্চা হবে। 
আজ রাজ্যের পরিস্থিতি কি? কি হবে এ রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ? অনুদানে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও, রাজ্যে পরিযায়ী স্রোত, নাবালিকা বিবাহ, নারী নির্যাতন, শিশু অপুষ্টি বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি দেশের ৭০৭টি জেলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে গবেষকরা দেখাচ্ছেন, নাবালিকা বিবাহে যে পাঁচটি জেলায় সর্বোচ্চ হার তার তিনটি পশ্চিমবঙ্গের- মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুরে ৬২-৬৬ শতাংশ মেয়ের বিবাহ হয় ১৮ বছরের আগে। ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের গর্ভধারণের হারও বেড়েছে। কি অবস্থা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার? কেনই আমরা তৃণমূল ও বিজেপি উভয়কেই পরাস্ত করার কথা বলছি? সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপি’র মন্ত্রীসভায় ও নির্বাচনী জোটে অংশগ্রহণ, সংসদে বিল পাস, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন সহ নানা ইস্যুতে মোদী সরকারকে সাহায্য, বর্তমানে এ রাজ্যে বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত, আরএসএস-এর শাখা বৃদ্ধিই প্রমাণ করে তৃণমূল কংগ্রেস কখনই বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে বিশ্বাসযোগ্য দল নয়। সারাদেশেই বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে আমাদের পার্টিই, বামপন্থীরা এজেন্ডা সেট করছে— তা ৩৭০ ও ৩৫ ক ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে, কৃষি বিল ও শ্রমকোড বাতিল, ইলেক্টোরাল বন্ড, সিএএ-এনআরসি বাতিল, মসজিদে সমীক্ষা বন্ধ প্রভৃতি প্রশ্নে। রুটিরুজির কথা ভুলিয়ে ধর্মীয় বিভাজনের লক্ষ্যে উসকানিমূলক বয়ান চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি ও তৃণমূল। মোহন ভাগবত তিন সন্তানের জন্ম দিতে বলছেন আর ফিরহাদ হাকিম সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কথা বলছেন। এসবই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। রাজ্যে নিকৃষ্টতম সমাজবিরোধীদের জড়ো করে সন্ত্রাস ও লুট চলছে। এ রাজ্যের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে-প্রায় ৭ লক্ষ কোটি টাকার ঋণের বোঝা দাঁড়াবে মার্চ, ২০২৫ সালে। লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস শক্তি সংহত করলেও কিংবা উপনির্বাচনে জিতলেও গত সাড়ে ১৩ বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে চূড়ান্ত স্বৈরাচারী শাসন কায়েম হয়েছে- এই মূল্যায়ন ভুল প্রমাণিত হয় না। পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণনা, আর জি কর-এ পিজিটি ছাত্রীকে নৃশংস হত্যা সহ নানা ঘটনায় প্রশাসন কার্যত দলদাসে পরিণত হয়েছে তা প্রমাণিত। আজকে বাংলায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নদীর বালি, পাড়ের মাটি, গবাদি পশু পাচার, জবরদখল ভেড়ি, পুকুর-জলাশয় ভরাট, অবৈধ ট্রলার, সিন্ডিকেট— এসব হলো অর্থ সমাগমের উপকরণ। এছাড়া সরকারের নানা প্রকল্পের ব্যয় দুর্নীতিও উপার্জনের স্রোত। গত কয়েক বছরে গ্রামাঞ্চলে বেড়ে উঠেছে নব্যধনী। লুম্পেনদের সাহায্যে ভয়ের পরিমণ্ডল এরাই তৈরি করছে। রাজ্যে তৃণমূলের রাজনীতির এরাই রক্তবাহী ধমনীজাল। সন্ত্রাস, বল প্রয়োগের সাথে সামাজিক বা কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে উপভোক্তা তৈরি করে তৃণমূল কংগ্রেস সম্মতি নির্মাণেও সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু কি অবস্থা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিষেবা ক্ষেত্রে। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলিতে কংকালসার ভয়ংকর চেহারা। ভাবা যায়, রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগার লুট হচ্ছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অফিসারের কাস্টোডি থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার আমানত পাচার হচ্ছে। পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিলম্ব, বিভ্রাট এখন নিত্য ঘটনা। স্কুলগুলিতে হতশ্রী চেহারা- ট্যাব পাওয়ার পর এবারে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১০/৩০ শতাংশ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত, স্কুল ছুট বাড়ছে, শিক্ষক নিয়োগ নেই। রাজ্যে ৮০০০-র উপর স্কুল উঠে যাচ্ছে। আর জি করে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস হত্যার পর রাজ্য জুড়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করলেন কারণ জনগণের এক বড় অংশ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি ক্ষুব্ধ। কেন্দ্র ও রাজ্যের সিবিআই এবং পুলিশ মিলেমিশে এই নৃশংস ঘটনার 'জাস্টিস'কে গুলিয়ে দিতে সক্রিয় ছিল প্রথম থেকেই। ৯০ দিন পরেও সিবিআই'র চার্জশিট দাখিল করতে না পারায় আসলে জনগণের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা কেবল পদদলিত হয় তা নয়- ধর্ষক, অপরাধী, থ্রেট কালচারে অভিযুক্তরাও উৎসাহিত হয়। সারদা থেকে আর জি কর, বিজেপি-তৃণমূলের নেতৃত্বের বোঝাপড়া পরিষ্কার। রাজ্যের জনগণ কর্পোরেট মিডিয়ার তৈরি বাইনারির বৃত্তের মধ্যে আটকে থাকা পছন্দ করছেন না। আমাদের কাছে বড় সুযোগ ভয়ের সংস্কৃতিকে ছিন্ন করে 'জাস্টিস'কে তার বিশেষ অর্থ থেকে প্রসারিত অর্থে উত্তীর্ণ করা। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, কর্মহীনতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিতদের পরিস্থিতি বদলের আওয়াজ তোলা স্বাভাবিক। পরিস্থিতি বদলের লক্ষ্যে জরুরি বিকল্পের আন্দোলন গড়ে তোলা এবং প্রান্তিক, সংখ্যালঘু মানুষকে বিকল্পের আন্দোলনে সংযুক্তির কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের রাজ্যে বাইনারি অপচেষ্টা ব্যর্থ করেই হিন্দুত্ববাদ, দুর্নীতি, অপশাসন রুখতে বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণকে এক জায়গায় আনতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাই সময়ের দাবি।
আসলে শ্রেণি বৈষম্য একমাত্র শ্রেণি শোষণের মাধ্যমেই যে বেড়ে ওঠে এই সহজ সত্য আমরা জানলেও অনুধাবন করতে পারি না। শ্রেণি ব্যবস্থা কোনও প্রাকৃতিক নিয়ম নয়, সমাজেরই সৃষ্ট। একশ্রেণির দ্বারা অপর শ্রেণির সৃষ্ট সম্পদ লুট করার আজকের লগ্নি পুঁজিবাদের নিত্যদিনের প্রক্রিয়াটিকে স্বাভাবিকত্বের মোহর লাগানো অমানবিক প্রচেষ্টা চিহ্নিত করাই আমাদের কাছে জরুরি কাজ। একথা জোরের সাথেই বলা যায়, উৎপাদনের উপকরণের ও মালিকানার সামাজিকীকরণ ছাড়া এই গোলকধাঁধা থেকে বেরুনো সম্ভব নয়, কোনও সমাধানই অসম্ভব। সমাজতন্ত্রই সেই জীবনরেখা লাইফ লাইন। শোষণহীন এক উন্নত, সমৃদ্ধ ভারত গড়ার মূল কান্ডারী শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলে সামনের দিনে প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার হিম্মত একমাত্র আমাদের পার্টির রয়েছে। এই আত্মবিশ্বাসকে অবলম্বন করেই মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন - এই চার হাতিয়ারকে শাণিত করে, ভারসাম্য পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment