CPI(M)

সুরক্ষায় আত্মরক্ষা, অধিকার রক্ষায় আত্মমর্যাদা

রাজ্য লোকসভা ২০২৪

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP

লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হলে সাংসদ তহবিলের এক-তৃতীয়াংশ টাকায় পশ্চিমবঙ্গে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও মহিলা আত্মমর্যাদা কেন্দ্র গড়ে তুলবেন সিপিআই(এম)’র মহিলা প্রার্থীরা। মহিলাদের প্রতি নির্যাতন ও বঞ্চনা প্রতিরোধে এবং তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে এই কেন্দ্র কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ ৫ সিপিআই(এম) প্রার্থী। রবিবার এক সাংবাদিক বৈঠকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে সিপিআই(এম) নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি বলেছেন, ‘নিজের হক নিজের ধকে’ আদায়ের জন্য এই লড়াই। মহিলাদের মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য, পায়ের তলায় মাটি শক্ত করার জন্য সিপিআই(এম) লড়ছে। তার জন্যই পার্টির মহিলা সাংসদদের তহবিলের এক তৃতীয়াংশ টাকা খরচ করে ২০২৪ সালের মধ্যেই গড়ে তোলা হবে মহিলা আত্মমর্যাদা কেন্দ্র এবং মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। 


নববর্ষের দিনে কলকাতায় পার্টির রাজ্য দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে এই সাংবাদিক বৈঠকে ছিলেন শ্রীরামপুর কেন্দ্রের প্রার্থী ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী দীপ্সিতা ধর, দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থী সায়রা শাহ হালিম, আসানসোল কেন্দ্রের প্রার্থী এবং মহিলা আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা খান, ঝাড়গ্রামের প্রার্থী সোনামণি টুডু মুর্মু এবং বোলপুরের প্রার্থী ও সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য শ্যামলী প্রধান। মিলিত ঘোষণায় তাঁরা বলেছেন, ১৫টি পদক্ষেপ নিয়ে মহিলাদের বিরুদ্ধে অন্যায় প্রতিরোধে ও তাঁদের অধিকার রক্ষায় নামা হবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা হলেও তিনি হিপোক্রিট। তাই রাজ্যের মহিলারা নিরাপদে নেই, তাঁদের অধিকারও নেই।
তাঁদের পক্ষ থেকে মীনাক্ষী মুখার্জি বলেছেন, বাংলায় সন্দেশখালির ঘটনা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা দেশে উন্নাও, হাথরস, কাঠুয়া, মণিপুরে মহিলারা নির্যাতিত হচ্ছে, এরাজ্যেও খুঁজলে ব্লকে ব্লকে সন্দেশখালি পাওয়া যাবে। কেবল নৃশংসতার সীমা অতিক্রম করা সন্দেশখালির মতো কিছু ঘটনা সামনে আসছে। একদিকে দারিদ্র, কর্মহীনতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অভাব, খাদ্যের অভাব, অন্যদিকে গার্হস্থ্য হিংসা থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসার মুখে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন আজকের মেয়েরা। এমন আক্রমণের মুখে কমিউনিস্ট পার্টি চুপ করে বসে থাকে না। ইতিহাসে আছে, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষের সময় মহিলারা এগিয়ে এসেছেন। তেভাগার সংগ্রামে, খাদ্য আন্দোলনের সময় মহিলারা রক্ত দিয়েছেন। সেই ঐতিহ্য নিয়েই আজকের পরিস্থিতিতে যাবতীয় অন্যায় ও নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শ্রমজীবী মহিলাদের অধিকার রক্ষায় নির্দিষ্ট কর্মসূচি নেওয়া হবে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও মহিলা আত্মমর্যাদা কেন্দ্র গড়ে তুলে। 
কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে দীপ্সিতা ধর বলেছেন, ‘‘মহিলা আত্মরক্ষার কথা বলা মানে মহিলাদের শারীরিকভাবে লড়াই করে নিজেদের রক্ষা করতে বলা নয়। তাহলে তো দেশের মহিলা কুস্তিগিরদের শ্লীলতাহানি ও লাঞ্ছনার শিকারই হতে হতো না। নির্যাতন থেকে রক্ষার দায় মহিলাদের একার নয়, গোটা সমাজের। আমরা মহিলাদের আত্মসম্মান, মর্যাদা রক্ষায় ক্ষমতায়নের কথা বলছি। আর্থিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলছি। এর জন্য ভারত সরকারের নির্ভয়া ফান্ড তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু গত দশ বছরে তার বেশিরভাগই খরচ হয়নি। নির্বাচনে জয়ী হলে আমরা পার্টির মহিলা সাংসদরা সাংসদ তহবিলের এক-তৃতীয়াংশ এই কাজে খরচ করবো।’’
কী কী করা হবে? দীপ্তিতা ধর বলেছেন, আত্মরক্ষা সমিতির কাজ হবে বহুমুখী। গার্হস্থ্য হিংসা, যৌন হেনস্তা সহ যে কোনও সমস্যায় আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। মহিলাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে গার্হস্থ্য হিংসায় হেল্পলাইন নম্বর চালু করে প্রত্যক্ষ সহায়তা দেওয়া হবে। কোনোভাবে নিগ্রহের শিকার হলে সারা জীবন ‘ট্রমা’ বয়ে বেড়াতে হয়, তাই নির্যাতিতার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ট্রমা কেয়ার ইউনিট তৈরি করবে আত্মরক্ষা সমিতি। আত্মরক্ষার জন্য যাঁরা আগ্রহী, তাদের মার্শাল আর্ট শেখানোও হবে। প্রশাসনের মদতে শাহাজাহান-শিবু-উত্তমরা থাকলে তারও প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সামাজিক উদ্যোগটাই বড় কথা। বাল্য বিবাহ এবং পণপ্রথা আটকাতেও কাজ করবে আত্মরক্ষা সমিতি। যে রাজ্যে জনপ্রতিনিধি নারী পাচারে যুক্ত থা,কে সে রাজ্যে নারী পাচার রুখতেও সক্রিয় থাকতে হবে। 
রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে এবং মহিলাদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলিকে যুক্ত করে, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ও পরিকাঠামোগুলির সঙ্গে সমন্বয় করে এই লক্ষ্যে এগবে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। মহিলা আত্মমর্যাদা কেন্দ্র গড়ে তুলে সারা বছর বিশেষত মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করা হবে। স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন ও বাড়ি বাড়ি স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দেওয়ার কাজ, ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থা সম্পর্কে মহিলাদের সচেতন করা হবে। শ্রমজীবী মহিলাদের শিশু সন্তানদের জন্য ক্রেশ চালু করা, যৌথ রান্নাঘর চালু করা, সাক্ষরতা ও বিজ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা, মহিলাদের স্বনির্ভর করে তুলতে সমবায় গঠন ও বিপণন কেন্দ্র গড়ে তোলা, তাতে কম সুদে ঋণের সহায়তা, মহিলাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা, মহিলাদের ঘরবন্দী দশা ঘোঁচাতে খেলার মাঠ ও ক্রীড়াক্ষেত্রকে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হবে। শুধু মহিলা নয়, প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদেরও অধিকার রক্ষা ও সহায়তা দিতে সক্রিয় থাকবে আত্মমর্যাদা কেন্দ্রগুলি। 
দীপ্সিতা ধর বলেছেন, এই সব কাজের জন্য নতুন পরিকাঠামো লাগবে না। রাজ্যে যে পরিকাঠামো আছে, তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলেই অনেক কিছু করা সম্ভব হবে। কিন্তু যে কাজ প্রশাসনের করার কথা ছিল, সেটা তারা করেনি। তাই তাঁরা বিকল্প পথ খুলতে বামপন্থী সাংসদ হিসাবে হস্তক্ষেপের এবং উদ্যোগ নেওয়ার কথা ঘোষণা করছেন। 
সায়রা শাহ হালিম এই প্রসঙ্গে বলেছেন, মহিলাদের অধিকার ও নিরাপত্তা থাকবে কী করে! তথ্য বলছে, ভারতে আইনসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ২১ জন সাংসদ ও ১১৩ জন বিধায়ক মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত। বিজেপি’র মোট ৪৪ জন জনপ্রতিনিধি মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে এবং ৭ জন জনপ্রতিনিধি ধর্ষণে অভিযুক্ত। এমন অভিযুক্তদের জনপ্রতিনিধিত্বে শীর্ষে আছে পশ্চিমবঙ্গ। এরাজ্যের ২৬ জন সাংসদ ও বিধায়ক মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত। এমন অবস্থা থাকলে রাষ্ট্রপতি বা মুখ্যমন্ত্রী মহিলা হলেও সুরাহা কীভাবে হবে? 
জাহানারা খান বলেন, ‘‘তৃণমূল সরকারের সময়কালে আমি বিধায়ক থাকাকালীন বিধানসভায় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলায় ট্রেজারি বেঞ্চের কটাক্ষ শুনেছি। নিরাপদ সর্দারকে সন্দেশখালির নারী নির্যাতন নিয়ে বলতে বাধা দিয়েছে। আর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পার্ক স্ট্রিটের ঘটনাকে ছোট ঘটনা বলেছিলেন।’’ শ্যামলী প্রধান বলেন, ‘‘আমি বিধায়ক থাকাকালীন তৃণমূলের প্রশাসন আমাকে বিধায়ক তহবিলের টাকায় উন্নয়ন করতেও বাধা দিয়েছে।’’ সোনামণি টুডু (মুর্মু) নিজে আদিবাসী এলাকায় স্যানিটারি প্যাড বণ্টন ও সচেতনতার প্রচারে যুক্ত ছিলেন। তিনিও নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বিশেষ করে স্কুল ছাত্রীদের মধ্যে এই ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
নির্বাচনের আগে তৃণমূল এবং বিজেপি দুই শাসক দলের পক্ষ থেকেই মহিলাদের শক্তিশালী করতে নানা ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মীনাক্ষী মুখার্জি বলেছেন, প্রতিশ্রুতি কেন, ওরা আগে রেজাল্ট কার্ড দেখাক। দশ বছরে কিছু না করে, কালো মুখ আড়াল করতে এখন আবার টোপ দেখাচ্ছে? কমিউনিস্ট পার্টি মহিলাদের এভাবে ভোটার হিসাবে দেখে না, সমাজ বদলের লক্ষ্যে কর্মসূচি নেয়।

Comments :0

Login to leave a comment