Editorial

আপাতত মন্দের ভালো

সম্পাদকীয় বিভাগ

দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে লাগাতার ধ্বংসলীলা চালিয়ে এবং বিরামহীন গণহত্যা চালিয়ে আধুনিক বিশ্বে সাম্প্রতিককালের নিকৃষ্টতম গণহত্যাকারী দেশ ইজরায়েল অবশেষে একরকম বাধ্য হয়েছে গাজায় সংষর্ঘ বিরতিতে সম্মত হতে। গত দু’বছরে এমন কোনও দিন যায়নি যেদিন ইজরায়েলী খুনে সেনাবাহিনী নিরীহ প্যালেস্তাইনদের খুন করেনি বা বাড়ি-ঘর, স্কুল, হাসপাতাল, ত্রাণ শিবির-আশ্রয় শিবিরে বোমা-ক্ষেপণাস্ত্রে ধূলিসাৎ করে দেয়নি। মানবতার বিরুদ্ধে এমন চরম অপরাধের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ব প্রতিবাদে উত্তাল হলেও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতা‍‌নেয়াহু চরম ঔদ্ধত্যে সব প্রতিবাদকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বারবার ঘোষণা করেছেন লক্ষ্যপূরণ না হলে সামরিক হামলা এবং গণহত্যা থামবে না। কি সেই লক্ষ্য? লক্ষ্য প্যালেস্তাইনের অস্তিত্বকে মানচিত্র থেকে মুছে দিয়ে সমগ্র গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে ইজরায়েলের অঙ্গীভূত করা। তার জন্য এই দুই প্যালেস্তাইন ভূখণ্ড থেকে সমস্ত প্যালেস্তিনিয়দের হয় গুলি-বোমা মেরে নিকেশ করতে হবে অথবা খাদ্য-চিকিৎসার চরম অভাব তৈরি করে অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু অনিবার্য করতে হবে। তার পরও যদি গাজায় কোনও প্যালেস্তিনি জীবিত থেকে যায় তাহলে তাড়িয়ে দিতে হবে। তার পর জনহীন গাজা পুরোপুরি দখল করবে ইজরায়েল। নিঃসন্দেহে এযাত্রায় সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তবে অদূর ভবিষ্যতে কি হবে এখনই আন্দাজ করা মুশকিল।
ইজরায়েলী গণহত্যার প্রধান মদতদাতা এবং সহায়তাকারী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি প্রস্তাবের ভিত্তিতে কয়েকদিন ধরে আলোচনার পর হামাস ও ইজরায়েল সংঘর্ষ বিরতিতে সায় দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী হামাস ইজরায়েলী পণবন্দিদের মুক্তি দেবে এবং ইজরায়েলের জেলে বন্দি প্যালেস্তিনিয়দের ছেড়ে দেওয়া হবে। গাজায় একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ইজরায়েলী সেনা প্রত্যাহার হবে। গাজা ও ইজরায়েলের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বার্তা স্বস্তির হাওয়া বয়ে এনেছে। তবে নানা মহল থেকে ইজরায়েলকে বিশ্বাস করায় দ্বিধা প্রবল। আসলে অতীতে অনেকবার এমন সংঘর্ষের পর শান্তি চুক্তি হলেও ইজরায়েল কখনই চুক্তির সব শর্ত মানেনি। প্রতিবারই বিরাট ভূখণ্ড নিজেদের দখলে রেখেছে। এবছর জানুয়ারিতে সংঘর্ষ বিরতি ঘোষিত হলেও নানা অজুহাতে দু’মাসের মধ্যে ফের গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ইজরায়েল।
ট্রাম্পের উদ্যোগে এই গণহত্যা বন্ধ হয়েছে বলে প্রচার করে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবার জন্য ছটপট করছেন। দু’বছর ধরে ৭০ হাজার মানুষ খুন, কয়েক লক্ষ্য জখম এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ আশ্রয়হীন হলেও ট্রাম্পের হৃদয় নাড়া দেয়নি। উলটে নেতানেয়াহু যাতে আরও বেশি ধ্বংস ও আরও বেশি খুন করতে পারে তার জন্য অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে গেছেন। আমেরিকা চাইলে গোড়াতেই এই জীবনহানি বন্ধ করতে পারত। কিন্তু করেনি। কারণ আমেরিকা চায় তাদের এজেন্ট হিসাবে মধ্য এশিয়া তথা আরব দুনিয়ায় ইজরায়েলী আধিপত্য। কিন্তু নেতানেয়াহুর অতি বাড়াবাড়ির জেরে আমেরিকারও বাধ্য হয়েছে লাগাম টানতে। গাজায় টানা দু’বছর গণহত্যায় ক্ষুব্ধ আমেরিকার ইউরোপীয় সহযোগীরা। তারা একে একে স্বাধীন প্যালেস্তাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ইজরায়েল কার্যত এক ঘরে হয়ে যেতে থাকে। তেমনি মার্কিন ঘনিষ্ঠ কাতারে ইজরায়েলের বোমা বর্ষণ মেনে নিতে পারেনি আমেরিকা। আবার এর ফলে মার্কিন বন্ধু আরব রাজতন্ত্রগুলির মধ্যে নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগ বাড়ে। সৌদি আরব আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক জোট গড়ে। অর্থাৎ গোটা পরিস্থিতিতে আমেরিকার প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব হবার আশঙ্কা দেখা দেয়। তাই ট্রাম্পকে যুদ্ধ বন্ধের একটা রাস্তা বার করতে হয়েছে। তবে এই রাস্তা স্থায়ী কোনও সমাধান সূত্র নয়। স্বাধীন ও সার্বভৌম প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই আসল শান্তি, আসল সমাধান।

Comments :0

Login to leave a comment