Post Editorial

কলকাতা মহানগরের জল নিকাশি ও মহা বিপর্যয়

উত্তর সম্পাদকীয়​

অশোক ভট্টাচার্য


কলকাতা মহানগর মহা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। গত দুই দিনের প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে বিপর্যস্ত কলকাতা। ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ কত বা এই বৃষ্টি মেঘ ভাঙা বৃষ্টি কিনা এই বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় রাজ্য সরকার ও কলকাতা পৌর কর্পোরেশন যে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ এ নিয়ে কোনও বিতর্ক বা সন্দেহের অবকাশ নেই। এর দায় অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কলকাতার মহানাগরিককে।
বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে তা স্বাভাবিক। দুই দশক রাজ্যের পৌর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী তথা কলকাতা পেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। সেই সময় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ থাকতো প্রাক বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তীকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পৌরসভা ও পঞ্চায়েতগুলিকে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যে। এক, প্রাক বর্ষা, দুই বর্ষা পরবর্তী Pre Monsoon, Post Monsoon. প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও দুটি দিক আছে (১)  Pre Disaster (২) Post Disaster. দুটি ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দেওয়া হতো সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের। গুরুত্ব দেওয়া হতো বিপর্যয় প্রবল এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করার ওপর সমতল ও পাহাড়ে। চিহ্নিত করা হতো জলবন্দি বা  বিপর্যস্ত মানুষদের উদ্ধার করে নিকটবর্তী আশ্রয়স্থলে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থার। অভিজ্ঞতায় দেখেছি এসব ক্ষেত্রে সমন্বয় ও নেতৃত্বদানের বড় ভূমিকা থাকে।
১৯৬৮ সালের জলপাইগুড়ির বন্যা পরিস্থিতির কথা স্মরণে আছে। তৎকালীন রাজ্যপালের প্রশাসনকে প্রাক বন্যা বিপর্যয় ও বন্যাজনিত পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করেছিল মানুষ।
আবার ১৯৭৮ সালে, তখন সবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজ্যের ১ম বামফ্রন্ট সরকার। ঐ বছরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন। মুখ্যমন্ত্রী আহ্বান করেছিলেন রাজ্যের মানুষের কাছে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বন্যাজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলার। অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছিলেন ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত সদস্যরা। অথচ একাজে অতীতের কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না পঞ্চায়েত সদস্যদের। কিন্তু তাদের দায়বদ্ধতা ছিল।
১৯৯৯ সালে কলকাতার জলবন্দি অবস্থা ও অতিবৃষ্টিতে বিপর্যয়ের দিনগুলির কথা মনে আছে। মানুষ তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত মানুষের পাশে। তখন আজকের মুখ্যমন্ত্রী তথা সেদিনের বিরোধী নেত্রীর ভূমিকার কথা আমাদের মনে আছে। এই কয়েক দিন আগে রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বলছিলেন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে। বামফ্রন্ট সরকারের সময় কলকাতা বর্ষার জলে ডুবে থাকতো। এখন কলকাতা ডোবে না। ঠিক তার পরেই কলকাতায় শারদ উৎসবের প্রাক মুহূর্তে এই বিপর্যয়। সতর্কবার্তা ছিল না, একথা বলা যায় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বড় ভূমিকা অবশ্যই আছে। গত দুই দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, বর্ষা বা অতি বৃষ্টির প্রভাব বেশি পড়ছে শহর বা নগর এলাকায়— যাকে বলা হয় Urban Hood।  জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শহরগুলিতে বেশি পড়ার বড় কারণ অবশ্যই শহরগুলিতে দূষণের মাত্রা অত্যধিক বেশি। বিশেষ করে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন শহরেই হয়ে থাকে অনেক বেশি হারে। তা উন্নত বা উন্নয়নশীল যে কোনও দেশ হতে পারে। এই কারণেই প্রতিটি শহরেই প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছিল Climate Change Action Plan পশ্চিমবঙ্গে তা প্রস্তুত করেছিল একমাত্র শিলিগু‍ড়ি শহরে। যখন এই লেখক শিলিগুড়ির মেয়র ছিলেন। যে উদ্যোগ শুধু জাতীয় ক্ষেত্রে নয়, প্রশংসিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। কলকাতায় তা হয়নি। যদিও বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই বৃহত্তর কলকাতার সামগ্রিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনায় বি‍‌শেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল নিকাশি পরিকল্পনা ও উন্নয়নে। তারই অঙ্গ হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছিল Wetland উন্নয়ন প্রকল্প। গৃহ নির্মাণ আইন কঠোর করা হয়েছিল। জলাশয় ও পুকুরগুলিকে চিহ্নিত করে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করা হয়েছিল। ইস্টান মেট্রোপলিটন, বাইপাস, কোনা এক্সপ্রেস‍‌ ওয়ের ৫০০ মিটার প্রস্থ পর্যন্ত কোনো নির্মাণ অনুমতি দেওয়া হতো না। কেএমডিএ’র অনুমতি ব্যতীত।
কলকাতা পৌর কর্পোরেশন এলাকায় ভূগর্ভস্থ নিকাশি ও পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা, নির্মাণ কাজে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে। সুব্রত মুখার্জি যখন মেয়র ছিলেন তখন ১৮০০ কোটি টাকার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ঋণে দ্বিতীয় পর্যায়ের নিকাশি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। রাজনীতিকে বাধা হতে দেওয়া হয়নি।
এর পর ১৪ বছর হয়ে গেছে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের অবসান হয়েছে। কলকাতা পৌর কর্পোরেশন পরিচালনা করছে তৃণমূল কংগ্রেস দল। বুকে হাত দিয়ে তারা বলতে পারবেন কলকাতার জল নিকাশি ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে দেখা শোনা করতে। তারা অবহেলা করেননি?
সময় মতো কলকাতার লাইফ লাইন বাগজোলা খাল, টলির নালা, চরিয়াল খাল সহ খালগুলির সংস্কার করেছে? নিকাশি পাম্পিং স্টেশনগুলির ক্ষমতা খতিয়ে দেখেছেন? বেআইনিভাবে উঁচু উঁচু অট্টালিকা নির্মাণের অনুমতি দেননি? কটা চিঠি লিখেছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, গঙ্গা নদীর পলি তোলার জন্য ড্রেসিং করার জন্য? অথচ কলকাতা মহানগরে জল প্রবাহিত করার প্রবণতা হলো পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে হুগলী নদীকে ভিত্তি করে।
শুনেছি কলকাতার একজন মেয়র পারিষদ সদস্য বাকুতে জলবায়ু পরিবর্তন মহা সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।

Comments :0

Login to leave a comment