RECRUITMENT SCAM

বিধায়কের বাড়ি থেকে উদ্ধার ৩৪০০ পরীক্ষার্থীর নথি

রাজ্য জেলা

SSC TET RECRUITMENT SCAM WEST BENGAL TMC BENGALI NEWS কীর্তিমান জীবনকৃষ্ণ সাহা

তাজ্জব সিবিআইয়ের আধিকারিকরাও। এর আগেও একাধিকজনের দুয়ারে হানা দিয়েছে সিবিআই, চলেছে তল্লাশি, জেরাও। তবে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূলী বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহার বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময় তিনি একের পর এক যা কাণ্ড করেছেন, তাতেই বিস্মিত আধিকারিকরা।


৩৪ ঘণ্টা পেরিয়েছে। তৃণমূলী বিধায়কের বাড়িতে শনিবার রাত পর্যন্ত সিবিআই’র আধিকারিকরা। বাড়ি ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। বিধায়কের কাছ থেকে যেন কোনও ‘গোপন’ নথি সংগ্রহ করতে না পারে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা, সেই কারণে তল্লাশি চালানোর সময়ে ব্লক ও অঞ্চলের স্থানীয় তৃণমূলী বাহিনীও তাঁর বাড়িতে ঢুকেছিল, তল্লাশিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। বারো জন তৃণমূল কর্মীকে এরপর বিধায়ককের বাড়িতেই আটক রেখে চলে তল্লাশি।


শেষমেশ তথ্য লোপাট করতে রাতেই দুটি মোবাইল ফোন বাড়ির পিছনে পুকুরে ফেলে দেন বিধায়ক জীবন সাহা। যদিও তাতেও রেহাই মেলেনি। রাত থেকেই পাম্প লাগিয়ে পুকুরের জল বের করার চেষ্টা চালানো হয়। শুক্রবার রাত দশটা নাগাদ শ্যালো পাম্প এনে পুকুর থেকে জল বের করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু বেশ গভীর ওই পুকুর। পুকুর ছেঁচে জোড়া ফোনের খোঁজে শুরু হয় তল্লাশি। সকালে আরও দুটি পাম্প এনে জল তোলার কাজ চলে। এর মাঝেই এদিন দুপুরে পুকুর লাগোয়া আঁস্তাকুঁড় থেকে নথি ভর্তি ৬টি ব্যাগ উদ্ধার করে সিবিআই।


আর এতেই সব জারিজুরি ধরা পড়ে যায়। কেন সব নথি লোপাটে উদ্‌ভ্রান্তের মতো এত কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিলেন বিধায়ক তা স্পষ্ট হয়ে যায় ব্যাগগুলি উদ্ধারের পরেই।


কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে জানা গেছে, ঐ ব্যাগ থেকে ৩৪০০জন প্রাইমারি, এসএসসি’র পরীক্ষার্থীদের নাম, অ্যাডমিট কার্ড, ঠিকানা মিলেছে!
ভাইপো সাংসদের ঘনিষ্ঠ বিধায়কের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যাগে প্রাইমারি টেট ও এসএসসি’র ৩৪০০জন প্রার্থীর নামের তালিকা! শুধু তাই নয়, টাকার অঙ্কের হিসাবের নথিও মিলেছে। প্রাইমারি টেট ছাড়াও, নবম-দশমের পরীক্ষার্থীদের নামের তালিকা মিলেছে। প্রার্থী পিছু সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা!


অর্থাৎ শুধু মাত্র তৃণমূলের এক বিধায়কের বাড়ি থেকেই নিয়োগ দুর্নীতিতে ৫১০কোটির হিসাব মিলেছে! তিন হাজারের বেশি পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পাইয়ে দেবার নামে টাকা তোলা হয়েছ। এই নথি হাতে আসার পরেই এদিন দুপুরের পরে কার্যত জেরায় ভেঙে পড়েছেন এই তৃণমূলী বিধায়ক। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে এমনকি মোবাইলও উদ্ধার হয়েছে। রাত পর্যন্ত চলছে জেরা, বাড়ছে গ্রেপ্তারি সম্ভাবনা। 


শাসক দলের প্রভাবশালী মহলে পৌঁছেছে এই বিপুল অঙ্কের টাকার একটা বড় ভাগ। এই তৃণমূলের বিধায়কের অন্যতম বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসাবে কাজ করত বড়ঞা বিধানসভা এলাকার ভড়ঞা গ্রামের বাসিন্দা, দাপুটে তৃণমূল কর্মী কৌশিক ঘোষ। কৌশিক ঘোষকে গত ফেব্রুয়ারিতেই গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। কৌশিক ঘোষের নাম মেলে অভিষেক ব্যানার্জির ‘আশীর্বাদে’ যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বনে যাওয়া ধৃত কুন্তল ঘোষকে জেরা করে। 

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, তৃণমূলী বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহা বড়ঞায় রীতিমতো অফিস খুলে অবৈধ নিয়োগের যে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলেছিল তার বড় অংশ কুন্তল ঘোষের মাধ্যমে কলকাতার নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হতো।  
তবে জীবন সাহার প্রতি পদক্ষেপ যেন দুঁদে অপরাধীর।

পেশায় স্কুল শিক্ষক, তৃণমূল বিধায়ক জীবন কৃষ্ণের অপরাধী মানসিকতায় বাস্তবিকই হতবাক সিবিআই আধিকারিকরাও। শুক্রবার বেলা ১২ টা নাগাদ কান্দিতে জীবন সাহার বাড়িতে ঢোকেন সিবিআই আধিকারিকরা। শুরু হয় জেরা, তল্লাশি। মাঝে বাড়ির বাইরে জেরক্সের দোকান থেকে নথিও জেরক্স করেন সিবিআই আধিকারিকরা।


এর মাঝেই বিকেল ৫টা নাগাদ দুই সিবিআই আধিকারিকের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে নিজের দুটি মোবাইল ফোন বাড়ির পিছনে পুকুরে ফেলে দেন জীবন সাহা। পাঁচিল টপকে মোবাইল পুকুরে ফেলে দেওয়ায় ঘটনায় স্তম্ভিত গোয়েন্দা আধিকারিকরাও। এরপরেই শুরু হয় আরও জেরা। যে পাঁচিল টপকে জীবন সাহা মোবাইল ফেলেছিলেন, সেই পাঁচিলে উঠে এদিন সকালে নিরীক্ষা চালান সিবিআই আধিকারিকরা। কতদূর যেতে পারে মোবাইল ফোন? বুঝতে পাঁচিল থেকে ছোঁড়া হয় ঢিলও। 


নিয়োগকাণ্ডেই ধৃত অয়ন শীল, তৃণমূলী শান্তনু ব্যানার্জির মোবাইলের মতো তাহলে কি জীবন কৃষ্ণ সাহার মোবাইলও সোনার খনি? কোন শীর্ষ সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী প্রভাবশালীর সঙ্গে কথোপকথন, টাকার সম্পূর্ণ হিসাব রয়েছে? নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের সঙ্গে যাবতীয় টাকার ডিলের তথ্যও কী লুকিয়ে আছে সেখানে? সিবিআই সূত্রে জানা গেছে একটি মোবাইল মিলেছে। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জীবন সাহার গ্রেপ্তারি এখন সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।


এরই মধ্যে কিছুদিন আগেই ভাইরাল হয় জীবন সাহার একটি কল রেকর্ডিং। সেই রেকর্ডিংয়ে ছিল, চাকরির জন্য এক ব্যক্তির থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিয়েছেন জীবন কৃষ্ণ সাহা। সেই টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেই হয় কথোপকথন। তবে প্রথমে অভিযোগ করলেও প্রভাবশালী বিধায়কের চাপে অভিযোগ থেকে সরে আসে অভিযোগকারীরা। তবে এই রকম বেশকিছু কল রেকর্ডিংয়ের হদিশ পেয়েছেন সিবিআই আধিকারিকরা।

সেই রেকর্ডিং মিলিয়ে নেওয়া যাবে মোবাইল ফোনেই।
নির্বাচন কমিশনকে জানানো নথি অনুসারে, জীবন সাহার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩ কোটিরও বেশি। যদিও এটা স্রেফ খাতায় কলমে হিসাব, প্রকৃত সম্পত্তির পরিমাণ আরও বহুগুণ। পরিচিত মহল থেকে এলাকায়, নিজের ধন সম্পত্তি নিয়ে বেশ গর্বও করেন বিধায়ক। রয়েছে তিনটি চারচাকা গাড়িও। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও একাধিক জমি রয়েছে বীরভূমে। স্ত্রীর নামেও জমি, বসতবাড়ি রয়েছে বীরভূমে। 

জানা গিয়েছে, পড়াশোনা শেষ করে প্রাথমিক স্কুলে পড়াতেন জীবন কৃষ্ণ সাহা। পরে চাকরি পান হাইস্কুলে। ২০১১ সালের পর থেকে হাত পাকান চাকরির দুর্নীতি চক্রে। ভুয়ো প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেটের চক্র গড়ে তোলেন জীবন কৃষ্ণ সাহা। সেই ভুয়ো প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেটকে হাতিয়ার করেই চাকরি পেতেন অযোগ্যরা। বদলে মোটা টাকা দিতে হতো জীবন কৃষ্ণ সাহাকে। এরপর সরাসরি তিনি ঢোকেন চাকরি বিক্রির চক্রে। 


শুধু চাকরি বিক্রি নয়, বড়ঞা এলাকায় বিধায়ক জীবন সাহার অঙ্গুলিহেলনেই চলে জমির রেকর্ডের দালাল চক্র। বেআইনিভাবে ঘুরপথে গ্রামবাসীদের জমি রেকর্ড হয়ে যায় অন্যের নামে। এই কাজেও সিদ্ধহস্ত জীবন সাহা। প্রথম বারের বিধায়ক হয়েও অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের অত্যন্ত কাছের জন বলেই পরিচিত জীবন সাহা। বীরভূম লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা জীবনের সাথে দহরম-মহরম ছিল অনুব্রত মণ্ডলেরও। ঘনিষ্ঠতা ছিল মানিক ভট্টাচার্যের সাথেও।

 

Comments :0

Login to leave a comment