Tea Garden Workers

কর্পোরেট পায় জমির ফ্রি হোল্ড, বাগান শ্রমিকের জন্য উদ্বাস্ত পাট্টা!

রাজ্য লোকসভা ২০২৪

টাকা নয়, জমির কাগজ চাই জানিয়ে জোট বাঁধছেন বাগান শ্রমিকরা। ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানে শ্যামল মজুমদারের তোলা ছবি।

পীযূষ ব্যানার্জি: জলপাইগুড়ি

দিনান্তে মাত্র ২৫০ টাকা যাঁদের গতরের দাম, তাঁরাই এখন এককাট্টা হয়ে জানিয়ে দিচ্ছে সরকারের ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তাঁদের দরকার নেই!
‘‘১ লাখ ২০ হাজার টাকায় আমাদের কী হবে বলতে পারেন? বাপ, দাদা থেকে বাগানে কাজ করছি। ২০০ বছর ধরে বাগানে পুরখো সে আমাদের বাস। আমাদের জমি চাই। টাকা নয়।’’ সোচ্চারে বলছিলেন ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানের মারিয়ানি ওরাওঁ। 
নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূল বিজেপি’র রাজনৈতিক যুদ্ধে ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে লড়াকু বাগান শ্রমিকদের জমির অধিকারের লড়াই। 
সকাল সাতটা থেকে শুরু করেছেন চা পাতা তোলার কাজ। এদিন ছিল ইস্ট ডিভিসনে পাতা তোলা। প্রথম পর্বের পাতা তোলা শেষ করে বাগান শ্রমিকরা জড়ো হয়েছিলেন পাতা ওজনের জন্য। বেলা তখন সাড়ে ৯টার আশেপাশে। এরপর আরও দু’দফায় পাতা তুলে কাজ শেষ করতে বেলা ৩টা গড়িয়ে যাবে। 
পাতা ওজনের জন্য লাইন দিয়ে জড়ো হওয়া বাগান শ্রমিকের দল সমস্বরে জানিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁদের জমির কাগজ চাই। যে কাগজে থাকবে জমির অধিকার। যে কাগজ জানিয়ে দেবে, শতকের পর শতক ধরে চা বাগানের যে জমিতে তাঁরা বাস একসাথে বাস করেছেন, সেই জমির অধিকার তাঁরা কোনোভাবেই ছাড়তে নারাজ।
এরাজ্যে গত এক দশকে সরকারি টাকা অনুদান খাতে খরচ করে দলীয় আনুগত্য কেনার রেওয়াজ চালু করেছে সরকার ও শাসক দল। সরকারি টাকার অনুদান পৌঁছে যায় পুজো কমিটিতে। শাসকের অত্যাচারে, রাজনৈতিক হিংসায় খুন থেকে মহিলার সম্ভ্রমহানির মতো ঘটনার পর টাকার ঝুলি নিয়ে পৌঁছে যায় শাসক দল। মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চান, তাঁর সরকার কতটা মানবিক।
চা বাগানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথমে চা সুন্দরী নাম দিয়ে প্রকল্প নিয়ে এসেছিল নবান্ন। বাগানের জমির অধিকার থেকে চা শ্রমিকদের উৎখাত করে জঙ্গল, নদীর ধারে আবাসন দপ্তরকে দিয়ে চা শ্রমিকদের জন্য বাড়ি তৈরির প্রকল্প এনেছিল রাজ্য সরকার। সরকারের চাল বুঝতে পারে বাগানের ট্রেড ইউনিয়ন। চা সুন্দরীর বাড়ি থেকে শেষ পর্যন্ত মুখ সরিয়ে নেয় বাগিচা শ্রমিকরা। একই সঙ্গে চা বাগানে শ্রমিকদের মধ্যে ক্রমশ জমির অধিকার নিয়ে তৈরি হতে থাকে আন্দোলন। 
এরপর পরিকল্পনা বদল করে রাজ্য সরকার। চা সুন্দরী প্রকল্পের বাড়ি থেকে সরে এসে বাগান শ্রমিকের জন্য জমির পাট্টা তুলে দেওয়ার সঙ্গে বাড়ি তৈরির জন্য ১লাখ ২০ হাজার টাকা অনুদানের টোপ নিয়ে আসে। 
পাট্টার জমির পরিমাণ কত?
৫ ডেসিমেল। যার অর্থ সাড়ে তিন কাঠা জমির মধ্যে বাগান শ্রমিকদের দখলে রাখা জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা। জমির ক্ষোভ যাতে সামনে না আসে তাই সামনে ঝোলানা হলো ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার প্রাপ্তি। সরকার ভেবেছিল, কাজ হবে। টাকার কাছে মাথা নুইয়ে যাবে বাগান শ্রমিকদের। যে রাজ্য সরকার মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে সরকারের লিজ হোল্ড জমিকে ফ্রি হোল্ড করে দিতে সময় নেয় না, সেই রাজ্যেই বাগান শ্রমিকদের জন্য সরকার উপহার মাত্র ৫ ডেসিমেল জমির অধিকার। 
গত ৩১ মার্চ থেকে উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকার দুই লোকসভা কেন্দ্র জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে সভার পর সভা করে মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছিলেন, চা বাগানের শ্রমিকদের সরকার জমির পাট্টা দিয়েছে। সঙ্গে বাড়ি তৈরি করার জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। ‘‘এখন ৫ ডেসিমেলের কাগজ নিলে, কালকে তো বাগানের ম্যানেজার এসে মাপজোক করে বাকি জায়গা নিয়ে নেবে। তখন কী হবে আমাদের। বছরের পর বছর ধরে জমির অধিকার আমরা কারোর কাছে ছাড়ব না।’’ জানাতে কসুর করেননি বাগান শ্রমিক রোহিত রোশন তিরকি।
টাকার টোপে বাগানের শ্রমিকদের মন ভোলানো যে যায়নি তা এখন পরিষ্কার। ‘‘সরকারের পাট্টা নিলে আমাদের জমি ছোটো হয়ে যাবে। আমরা যে এরিয়া নিয়ে আছি, সেই জমির কাগজ চাই।’’ বলছিলেন ডেঙ্গুয়াঝাড় বাগানের ডাঙা লাইন মহল্লার আলমা কুজুর। 
লক্ষ টাকার হাতছানি এখানে গৌণ। লড়াইয়ে কেন্দ্রে ঘুরপাক খাচ্ছে জমির অধিকারের একখণ্ড কাগজ। মাথায় চা পাতার বোঝা নামিয়ে বাগান শ্রমিক সুনীতা ওরাওঁ জানিয়ে দেন, ‘‘পয়সা নেহি চাহিয়ে, জমিন চাই আমাদের।’’ সেই কবে সাঁওতাল পরগণা থেকে আনা হয়েছিল আদিবাসীদের। চার-পাঁচ পুরুষ ধরে এখানে বাস করছেন। সমাজ গঠন করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। বিভাজনের সব রকমের প্রয়াসের মধ্যেও তৈরি করেছেন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। সেই চা বাগান শ্রমিকদের জন্য এখন বরাদ্দ মাত্র ৫ ডেসিমেল জমি।
আবার সেই জমির পাট্টার কাগজ আসছে রাজ্যের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের মাধ্যমে। এরাজ্যে ভূমিহীনদের জমি দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৫৫সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড রিফর্মস অ্যাক্টের ৪৯ নং ধারায় জমির অধিকার পেয়েছিলেন ভূমিহীনরা। আবার উদ্বাস্তু জনগণের জন্য পাট্টার অধিকারের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল নিঃশর্ত দলিল। শ্রমিক থেকে সরকার বাগিচা শ্রমিকদের জমির পাট্টা দিয়ে উদ্বাস্তু লেবেল সুকৌশলে সেঁটে দিতে চাইছে। সিএএ নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করতে এবার ব্যবহার করা হবে চা শ্রমিকদেরও।
জমির অধিকার তাই ক্রমশ জোরালো হচ্ছে চা বাগানে মহল্লায় মহল্লায়। নির্বাচনী উত্তাপে বাইরে থেকে টের পাওয়ার উপায় নেই। শহর ছাড়িয়ে, বসতি পার করে চা বাগানে পা রাখলে চা শ্রমিকরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের দাবি জমির কাগজ। সেখান থেকে সরার কোনও সম্ভাবনাই নেই। চা বাগান আন্দোলনের নেতা জিয়াউল আলমও তাই জানিয়েছেন, ‘‘আমরা প্রথম থেকে যে কথা বারেবারে বলে এসেছি, যে শ্রমিক পরিবার যতটা জমিতে আছে, ততটাই জমি পাবে। তা ২ডেসিমেল হোক আর ২২ ডেসিমেলই হোক।’’

Comments :0

Login to leave a comment