Manipur violence

দুই পড়ুয়ার দেহকে ঘিরে উত্তাল মণিপুর, বিক্ষোভকারীদের হটাতে পুলিশের লাঠি, গুলি

জাতীয়

আরও এক ভয়ঙ্কর ঘটনা সামনে এল মণিপুরে। আড়াই মাস আগে দুই পড়ুয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে হিংসা কবলিত পার্বত্য রাজ্যটি। ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানী ইম্ফল শহর। মঙ্গলবার ইম্ফল উপত্যকার বিভিন্ন জেলায় মিছিল, বিক্ষোভ, অবরোধ করেন পড়ুয়ারা। আন্দোলন দমন করতে পড়ুয়াদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে পুলিশ। আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর গুলি পর্যন্ত চালিয়েছে। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ এবং গুলিতে অন্তত ৬০ ছাত্র গুরুতর জখম হয়েছেন। এরমধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, রাজ্যে ফের ইন্টারনেট পরিষেবা বাতিল করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। শুক্রবার পর্যন্ত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইম্ফল পূর্ব ও পশ্চিম জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি হয়েছে। ইম্ফল শহরে অতিরিক্ত সেনা নামানো হয়েছে। 
রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হলে পরে আরও নৃশংস ঘটনা সামনে আসবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বাস্তবে তা ঘটল। পাঁচ মাস পর গত শনিবার রাজ্যে ফের ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করে সরকার। এদিন রাতে দুই মাস ধরে নিখোঁজ দুই ছাত্র-ছাত্রীর হত্যাকাণ্ডের ছবি ভাইরাল হয়। কিন্তু সেই ছবিটি অস্পষ্ট থাকায় কেউ ঘটনাটি বুঝতে পারেননি। তবে সোমবার রাতে এই ঘটনার একাধিক ছবি ভাইরাল হওয়ার পর আসল ঘটনা সামনে আসে। তার মধ্যে একটিতে দেখা যাচ্ছে কমবয়সি দুই যুবক-যুবতী ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। দুজনের পেছনে বন্দুক হাতে দুই যুবক দাঁড়িয়ে আছে। এদের মুখের ছবি স্পষ্ট নয়। তবে তাদের গায়ে উগ্রপন্থীদের মতো পোশাক রয়েছে। আরও একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওই দুই যুবক-যুবতীর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। এরমধ্যে যুবকের দেহ মুণ্ডহীন।

দেহগুলির পরিচয় পাওয়া গিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। নিহত যুবকের নাম ফিজাম হেমানজিৎ (২০)। যুবতীর নাম লিনথোইঙ্গাম্বি হিজাম (১৭)। দু’জনই মেইতেই গোষ্ঠীর। তাঁদের বাড়ি ইম্ফল শহরে। তাঁরা গত ৬ জুলাই থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তাঁদের মোবাইল ট্র্যাক করে দেখা গিয়েছে দুজনের সর্বশেষ উপস্থিতি ছিল চুরাচাঁদপুর জেলার লাদবান এলাকার একটি পার্কে। দু’জনের হত্যাকারীর সন্ধান এখনও খোঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। তাছাড়া এঁদের লাশগুলিও খোঁজে পায়নি পুলিশ। মেইতেই সংগঠনগুলির দাবি, কুকি উগ্রপন্থীরা দুই ছাত্র-ছাত্রীকে হত্যা করেছে। 
নিহতদের পরিচয় সামনে আসার পরপরই সোমবার রাতেই উত্তাল হয়ে উঠে ইম্ফল শহর। রহস্যজনক বিষয় হলো, ইম্ফল শহর উত্তাল হওয়ার পর মধ্যরাতে আচমকা মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলা হয়, ওই দুই যুবক-যুবতীর মৃত্যুর ঘটনার তদন্তের ভার গত ২৮ আগস্ট  সিবিআই’’র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তদন্তের কাজ জারি আছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। সরকারের এই বিবৃতিকে কেন্দ্র করে রহস্য দানা বাঁধছে। কারণ নিখোঁজ যুবতীর বাবার এজাহারকে ঘিরে বীরেন সিং সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গত ৮ জুলাই রাতে ইম্ফল শহরের হিজম কুলজিৎ সিং নামের এক ব্যক্তি সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ৬ জুলাই সকালে তাঁর মেয়ে লিনথোইঙ্গাম্বি হিজামকে কোচিং সেন্টারে ছেড়ে দিয়ে আসেন। কিন্তু কোচিং শেষে মেয়ে বাড়ি ফিরে আসেনি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েও তাঁর সন্ধান মিলেনি। অবশেষে এই কোচিং সেন্টারের কাছে থাকা মণিপুর রুরাল ব্যাঙ্কের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ফিজাম হেমেনজিৎ নামের এক যুবক মোটরবাইকে করে তাঁর মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। হেমেনজিতের বিরুদ্ধে তিনি অপহরণের অভিযোগ জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেমঘটিত ঘটনা মাথায় রেখে পুলিশ হেমেনজিতের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা দায়ের করে তদন্তে নামে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি হেমেনজিতের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা নথিভুক্ত করে যখন পুলিশ তদন্ত করছে, তাহলে এই ঘটনার তদন্তের ভার সিবিআই’’র হাতে কেন তুলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার? তাহলে কি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আগে থেকেই জানতেন ওই যুবক-যুবতীদের হত্যা করা হয়েছে।? যদি সরকার ঘটনাটি জেনে থাকে, তাহলে এতোদিন ধরে কেন তা লুকিয়ে রেখেছিল? এই প্রশ্নগুলির জবাব নেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। 
এদিকে, মঙ্গলবার সকাল থেকে ইম্ফলের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নেয়। উপত্যকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে পড়েন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রী মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় ঘেরাও করতে মিছিল বের করেন। সিঙ্গেমাই এলাকায় মিছিল পৌঁছাতেই কোনও ব্যারিকেড না গড়ে আচমকা মিছিলকারীদের উপর হামলে পড়ে পুলিশ। প্রথমে কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায়। এরপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। একইসঙ্গে গুলিও ছোঁড়ে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, সচিবালয় ঘেরাও রুখতে তারা রাবার বুলেট ছুঁড়েছে। কিন্তু বহু ছাত্রের পায়ে গুলির চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। জখম ছাত্রদের ইম্ফলের রিমস, জেএনআইএমএস ও মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। থাওবেল, কাকচিং, বিষ্ণুপুর জেলায়ও ছাত্রদের উপর আক্রমণ করেছে পুলিশ। 
এই ঘটনায়  রাজ্য ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিরোধীরা। কংগ্রেস নেত্রী এক্স হ্যান্ডেলে মন্তব্য করে বলেন, ‘মণিপুরে জাতিগত হিংসার শিকার হচ্ছে শিশুরাও। মণিপুরে যে ভয়ঙ্কর অপরাধ হচ্ছে তা নজিরবিহীন। সেগুলিকে চলতে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত।’’ নিহত দুই ছাত্র-ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে তাঁদের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মেঘচন্দ্র সিং।

Comments :0

Login to leave a comment