ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সর্বোপরি সংবিধান রক্ষার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন ভারতের জনগণ। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন নিছক কোনও দল বা জোট ক্ষমতা দখল করবে সেই লড়াই ছিল না। ছিল দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াই। তাই দেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী শক্তি, নিজেদের মধ্যে নানান মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একমঞ্চে শামিল হয়েছিল, একসঙ্গে হাতে হাত ধরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল। মানুষ সেই জোটবদ্ধ লড়াইকে সমর্থন জানিয়েছেন।
নির্বাচনের অনেক আগেই নরেন্দ্র মোদী তাঁর দল ও তাদের জোট এনডিএ’র লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়ে বলেছিলেন দলগতভাবে ৩৭২ এবং জোটগতভাবে ৪০০ আসনের বেশি জিততে হবে। অর্থাৎ সংবিধান বদলে আরএসএস’র স্বপ্নের হিন্দুত্ববাদী ভারত রাষ্ট্র গড়তে সংসদে যে পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার সেটাই ছিল মোদীর লক্ষ্যমাত্রা। জনগণ সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছেন। রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন দেশের বিচিত্র এবং ঐক্যের বাতাবরণ। শুধু তাই নয় এককভাবে সরকার গড়ার সুযোগও দেয়নি বিজেপি-কে। শেষ পর্যন্ত যদি সরকার গড়েও, তাহলে সরকার গড়তে হলে বিজেপি-কে অন্যান্য দলের উপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ একতরফাভাবে মোদী ছড়ি ঘোরাতে পারবেন না। হুঙ্কার দেবার ক্ষমতাও কেড়ে নিয়েছেন দেশের মানুষ। দরকারে তাঁদের সঙ্গী-সাথিদের চাপের কাছে মাথা নুইয়ে চলতে হবে।
গত পাঁচ বছরে বিজেপি’র জোট এনডিএ’র কোনও অস্তিত্ব ছিল না। বিরোধীদের ইন্ডিয়া মঞ্চ গড়ে ওঠার পর হঠাৎ এনডিএ’র কথা মনে পড়ে তাঁদের। জোটের কথা বললেও বিজেপি তার কোনও সঙ্গী বা শরিককে মর্যাদা দেয়নি। গোটা নির্বাচনী প্রচারে জোট শরিকদের কোনও গুরুত্বই ছিল না, প্রচার চলেছে মোদীর নামে। তিনিই জোট, তিনিই দল। মোদীর সরকার গড়ার জন্য মোদীর গ্যারান্টি বিলি করা হয়েছে। দলে নামেই ভোট নয়, জোটের নামতো দূরের কথা, ভোট চাওয়া হয়েছে মোদীর নামে। এক ব্যক্তি মানুষকে অবতার সাজানো হয়েছে। নিজেকে অবতার বানিয়েছেন মোদী নিজেই। ফ্যাসিস্ত আবহ তৈরি করা হয়েছে গণতন্ত্রের পরিসরকে মুছে ফেলে স্বৈরতন্ত্রের পথ তৈরির জন্য। মানুষ তা হতে দেননি। মহাগুরু-বিশ্বগুরুকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে টেনে নামিয়ে দিয়েছেন। তাই এটা মোদী এবং তাঁর সরকারের নৈতিক পরাজয়।
প্রচারে প্রধান অস্ত্র হিসাবে মোদী এবং তাঁর দলবল ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক ও জাতপাতের বিভাজনকে ব্যবহার করেছিলেন উগ্রভাবে। মানুষ তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। উত্তর প্রদেশে কার্যত মোদী-যোগীদের জন্য বিপর্যয় নামিয়ে এনেছেন সেরাজ্যের মানুষ। রাম মন্দিরের আবেগ হাওয়ায় উবে গেছে খোদ উত্তর প্রদেশেই। আরও অনেক রাজ্যে তার ধাক্কা পৌঁছেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিন্দি বলয়ে যেখানে বিজেপি-কে শাসক হিসাবে মানুষ দেখেছে সেখানে বিজেপি’র শক্তিক্ষয় বেশি হয়েছে। বাড়তি সুবিধা পেয়েছে যেখানে বিজেপি আগে ক্ষমতা দখল করেনি। অবশ্য দক্ষিণ ভারতে এই প্রবণতা নেই।
এই লড়াইয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছেন দেশের কৃষক সমাজ, দরিদ্র, শ্রমজীবী, আদিবাসী, দলিত, বিপন্ন সংখ্যালঘুরা। অর্থাৎ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সংবিধান যে অংশের মানুষের অধিকার, মর্যাদা, সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে তারাই সংবিধান রক্ষার লড়াইয়ে বুক পেতে দিয়েছেন।
EDITORIAL
জয় ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সংবিধানের
![](https://ganashakti-new-website.s3.ap-south-1.amazonaws.com/17225/666017d3cb9a4_Editorial.jpg)
Comments :0