November Revolution

নভেম্বর বিপ্লব: পুঁজি-শ্রমের দ্বন্দ্ব মীমাংসার বার্তা

উত্তর সম্পাদকীয়​

আভাস রায় চৌধুরি 
শ্রমিক বিপ্লবের এতদিনের চালু ধারণার বিপরীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়ায় সফলভাবে সংগঠিত হলো সমাজ বিপ্লব। মার্কস-এঙ্গেলসের বিপ্লব প্রত্যাশার ক্ষেত্র রাশিয়া না হলেও, ১৮৮২ সালের কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারের রুশ সংস্করণের ভূমিকায় তাঁরা রাশিয়ায় পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ এবং ভূমি ব্যবস্থার বিশেষ চরিত্রের মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করেন। এই সূত্র ধরে লেনিন দেখালেন রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব সম্ভব। 'সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়' রচনায় লেনিন বিপ্লব সম্ভাবনার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা উপস্থিত করলেন। বইটি ১৯১৭ সালে, রুশ বিপ্লবের বছরেই, প্রকাশিত হয়েছে।
রুশ বিপ্লবের এই ব্যতিক্রমী সাফল্যকে আন্তোনিও গ্রামশি সংবর্ধিত করেছিলেন, 'রেভলিউশন এগেনস্ট দাস ক্যাপিটাল'। এই সম্বোধন মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগকেই উল্লেখ করেছে, কারণ কোনও সমাজ বিপ্লবই পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলির কপি-পেস্ট হয় না; বরং বিপ্লবীদের নিজের সমাজের বাস্তব পরিস্থিতিতে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য সৃষ্টিশীল সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়।
রুশ বিপ্লব এই পৃথিবীতেই আর একটা নতুন পৃথিবী উপস্থিত করেছিল। নতুন এই পৃথিবীতে শ্রেণি শোষণ, সামাজিক নিপীড়ন, জাতিসত্তার নামে আধিপত্য, দারিদ্র, অনাহার, অশিক্ষা মুক্ত সমমর্যাদার ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির বিজয় এবং এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছিল। ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করে রবীন্দ্রনাথ এই সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করেছিলেন ('রাশিয়ার চিঠি', বিশ্বভারতী)।
বিপ্লবের পরে শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে খতম করে দেওয়ার জন্য ১৪টি সাম্রাজ্যবাদী দেশ মহা ষড়যন্ত্র চালায়। মাইকেল সেয়ার্স এবং অ্যালবার্ট কাহন বর্ণিত 'দ্য গ্রেট কনসপিরেসি এগেনস্ট রাশিয়া' রচনায় ১৯১৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু সমাজতন্ত্রের নির্মাণই করেনি, কয়েক দশকের মধ্যে পুঁজিবাদী দুনিয়ার সমকক্ষ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণি ও কমিউনিস্ট পার্টির অসম্ভবের সম্ভব সাধনকারী ভূমিকা ছাড়া এটা কখনোই বাস্তবায়িত হতো না। বিপ্লবের পরে লেনিনের নেতৃত্বে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ওয়ার কমিউনিজম এবং যুদ্ধের শেষে সমাজতন্ত্র নির্মাণের বাস্তবতা বিচার করে নয়া অর্থনৈতিক নীতি (NEP) রূপায়ণ করেছিল তারা। সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রতিটি পর্বে সোভিয়েত শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণকে আন্দোলনে যুক্ত করতে পেরেছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, উন্নত জীবনমান সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সামনের দিকে এগিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দু’কোটির বেশি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ে রক্ষা পেয়েছিল সমগ্র মানব সভ্যতা। সমাজ, সভ্যতা ও মানবতার জন্য এত বড় আত্মত্যাগ পৃথিবীর কোথাও নেই। স্তালিন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে আরও মানবিক, উজ্জ্বল ও শক্তিশালী করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের কেন্দ্র ব্রিটেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই পর্বটি ঠান্ডা যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
পৃথিবী জুড়েই পুঁজিবাদের বাজার সর্বস্ব অর্থনীতির পরিবর্তে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রভাব পড়ে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ স্থাপনের নীতির পরিবর্তে প্রতিটি জাতির পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই প্রথম প্রকৃত পক্ষে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী সমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রথম সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতিতে পুঁজি ও শ্রমের মৌলিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা সম্ভব হলো। এই প্রথম ধর্ম পরিচয় কিংবা ধর্ম আচরণের দোহাই দিয়ে শ্রেণি শোষণ ও সামাজিক নিপীড়নকে উৎখাত করা হলো। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব সমকালীন পৃথিবীর উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। শক্তিশালী সোভিয়েত সমাজতন্ত্র জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে উৎসাহিত করে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করেছে।
শৃঙ্খল ছাড়া তাদের হারানোর কিছু নেই, কিন্তু জয় করার জন্য গোটা দুনিয়া পড়ে রয়েছে। দুনিয়ার মজদুর এক হও। মানব মুক্তির লক্ষ্যে সমাজ বিপ্লবের কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারের এই আহ্বানকে সমকালীন বুর্জোয়ারা সচেতনভাবে উপেক্ষা করেছিল। এঙ্গেলস বলেছিলেন 'নৈশব্দের ষড়যন্ত্র'। আজকের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যেমন শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকে ব্ল্যাক আউট করে, ঠিক তেমনই। হাজার হাজার বছর ধরে শোষণ ভিত্তিক সমাজে প্রলয়ের সম্ভাবনা ঘটেছে, স্পার্টাকাস ও তার সহযোদ্ধারা প্রথম প্রলয় ঘটানোর চেষ্টা করেছিল।

অবদমিত শোষিত মানুষ মুক্তির জন্য বারে বারে লড়েছে। ১৭৮৯-র ফরাসি বিপ্লব প্রথম সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার কথা শুনিয়েছিল, কিন্তু পুরানো শোষক শ্রেণির পরিবর্তে নতুন শোষক শ্রেণির (বুর্জোয়া) জন্ম হয়। নতুন বৈশিষ্ট্য ও নৈতিকতা নিয়ে 'শ্রেণি-সমাজ' ও 'শোষণ' অটুট রইল। তাই শেষ পর্যন্ত 'সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা'-র স্লোগান মানব মুক্তির স্থায়ী ঠিকানা আনতে পারেনি। তবুও মানুষ লড়েছে। আধুনিক সমাজের 'বিপ্লবী শ্রেণি' শ্রমিক শ্রেণি লড়েছে, লড়ে চলেছে। প্যারিস কমিউন, ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার পরেও এসেছে ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব। তারপর চীন, কিউবা, কোরিয়া, ভিয়েতনাম। ভিন্ন ভিন্ন পথে মানব মুক্তির লক্ষ্যে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব সফল হয়েছে।
শ্রেণি সমাজে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব যতক্ষণ অমীমাংসিত থাকে, ততক্ষণ শোষণ ব্যবস্থা অটুট থেকে যায়। আধুনিক বুর্জোয়া সমাজে এই অমীমাংসিত দ্বন্দ্বটি হলো পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব, যা পুঁজিবাদী সমাজ অর্থনীতিতে মৌলিক দ্বন্দ্ব। পুঁজি মুনাফা ও নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই নিয়ত প্রযুক্তির বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে, যা উৎপাদিকা শক্তিকে আরও উন্নত ও বিকশিত করে। উন্নত ও বিকশিত উৎপাদিকা শক্তি যদি পুরানো উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বাঁধা পড়ে থাকে, তবে এই বাঁধন ছিড়ে মানুষ নতুন উৎপাদন সম্পর্কে পৌঁছায়। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের রূপান্তর আসলে উৎপাদিকা শক্তির অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ও উন্নত উৎপাদন সম্পর্কে পৌঁছানো। পুঁজিবাদী সমাজের এই রূপান্তর অনিবার্য, তবে তা আপনা-আপনি আসে না।
পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক আধিপত্য অটুট রাখার জন্য রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়িয়ে চলে এবং মানুষের সম্মতি গড়ে তোলার জন্য মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করে। আজকের দিনে মিডিয়া পুঁজিবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নয়া উদারবাদী পৃথিবীতে অর্থনৈতিক আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে ভুক্তভোগী মানুষের সম্মতি গড়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপকরণের প্রভাবশালী ভূমিকা রয়েছে, যা পণ্য বাজার গড়ে নিতেও ভূমিকা নিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে মার্কসের 'কমোডিটি ফেটিসিজম' ধারণাটির পুনঃচর্চা হতে পারে। তবুও বিপণনী বিজ্ঞাপনের তীব্র আলোতে শ্রমজীবী মানুষের জীবন যন্ত্রণা আড়াল করা যাচ্ছে না। এই যন্ত্রণার উৎস অতি মুনাফার জন্য তীব্র শোষণ। রুশ বিপ্লব পুঁজি-শ্রমের অমীমাংসিত মৌলিক দ্বন্দ্বের অবসান করেছিল। এটাই রুশ বিপ্লবের মৌলিক বার্তা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগে (১৯৪৫-৭০) পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও বেকারির হার অত্যন্ত নিচে নেমে এসেছিল। ফলে এই সুযোগে উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির দরকষাকষির ক্ষমতা বেড়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে পুঁজিবাদ নতুন সঙ্কট পর্বে প্রবেশ করে এবং এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজতে নয়া উদারবাদের পথ ধরে। নয়া উদারবাদে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কমিয়ে বাজারের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উৎপাদন ক্ষেত্রের পরিবর্তে ফাটকা কারবারকেই মুনাফা অর্জনের রাস্তা হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। ফলে আজকের নয়া উদারবাদী পৃথিবীতে উৎপাদনের ক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েছে। তথাকথিত বিশ্বায়নে সস্তায় শ্রম পাওয়ার খোঁজে পুঁজিবাদ উৎপাদন ও পরিষেবা প্রক্রিয়াকে গোটা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে, তাতে বড় বড় কর্পোরেটগুলি শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠিত প্রতিরোধ সহজেই এড়িয়ে চলতে পারছে।
পৃথিবীব্যাপী সর্বোচ্চ মুনাফা সংগ্রহকারী বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনগুলির প্রায় কোনোটাই উৎপাদনের ক্ষেত্র পরিচালনা করে না। পরিষেবা এখন মুনাফা অর্জনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। কোভিড উত্তর পৃথিবী পরিষেবা ক্ষেত্রে গিগ অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে শ্রমজীবী মানুষ তার মালিক চেনে না, জানে না কার জন্য তার ঘাম রক্ত চুষে নিচ্ছে পুঁজি। আজকের লুটেরা অর্থনীতির অন্যতম ক্ষেত্র হলো গিগ। উৎপাদন ও পরিষেবার ধরন এবং শ্রম-সম্পর্ক বদলে যাওয়ায় আজকের শ্রমজীবীদের বড় অংশ এক জায়গায় সংগঠিত নয়। এই প্রলেতারিয়েতকে অসংগঠিত বলে ঘোষণা করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এদের প্রতি দায়িত্ব পালনকে লঘু করতে চায়।
আজকের পুঁজির মুনাফার অন্যতম ক্ষেত্র হলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান দখল করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করা। মানব সম্পদের সীমাহীন লুট সম্ভব হচ্ছে, কারণ পৃথিবীব্যাপী বেকারির হার ক্রমবর্ধমান। প্রলেতারিয়েতের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু উল্টোদিকে গোটা সমাজের ব্যাপক প্রলেতারীয়করণ ঘটে চলেছে। ক্রমবর্ধমান বেকারি অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত। আজকের পৃথিবীতে রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থা ও নয়া ফ্যাসিবাদ এই উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি অর্থাৎ বেকার বাহিনীকে নিজেদের হাতিয়ারে পরিণত করতে চাইছে। ভারতের ক্ষেত্রে হিন্দুত্ব কর্পোরেট হলো এর উদাহরণ।
আজ সমাজতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে। চীনের প্রধান শক্তি প্রযুক্তি ও উৎপাদন ক্ষেত্রের বিপুল বিকাশ। বাজার ব্যবস্থার বিস্তারে ফলে চীনের সমাজ, অর্থনীতিতে পুঁজি-শ্রমের দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী অর্থনীতির মধ্যেই চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার হলেও, পুঁজি-শ্রমের মৌলিক দ্বন্দ্বে চীন রাষ্ট্র দেশের মানুষের পক্ষে। সমাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্যই চীনের আজকের সংগ্রাম। বিপুল জন-অংশের আর্থিক 'সমৃদ্ধি' নিশ্চিত করা বর্তমান চীনের সংস্কারের মূল লক্ষ্য। সম্প্রতি চীন দরিদ্র মুক্ত দেশ হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করতে পেরেছে। আজকের প্রায় প্রতিটি ভূ-রাজনৈতিক বিরোধে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদ ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে চীন স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী পর্বে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে শ্রমিক বিপ্লব প্রচেষ্টা আসলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম। দেশের অভ্যন্তরে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবই হতে হবে।
নভেম্বর বিপ্লব রুশ দেশে পুঁজি-শ্রমের মৌলিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে পেরেছিল। আজকের আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পরিচালিত পৃথিবীতে রাজনৈতিক ভারসাম্য পুঁজির অনুকূলে। শ্রমিক শ্রেণি আত্মরক্ষার সংগ্রামে অবিচল আছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনের ফলাফলের দিকে গভীরে দৃষ্টি দিলে সমাজের নিচের তলার মানুষের জীবন-যন্ত্রণা অর্থাৎ পুঁজি-শ্রমের মৌলিক দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গটি ফিরে আসে। পুঁজিবাদের আকাঙ্ক্ষা সর্বোচ্চ মুনাফা। বিপরীতে পুঁজি-শ্রমের মৌলিক দ্বন্দ্ব শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামের মূল ভিত্তি। শ্রমজীবী মানুষের কাছে লড়াইয়ের বার্তা নিয়ে যেতে হয়; শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী ও সংগঠিত বাহিনী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির এটা দায়িত্ব।
ভারতেও নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বেপরোয়া প্রয়োগ তিন দশক অতিক্রম করেছে। আরএসএস/বিজেপি পরিচালিত হিন্দুত্ব-কর্পোরেট আঁতাতের সরকার ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির লুটতন্ত্রের বলয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে। নয়া উদারবাদী লুটতন্ত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র এখন লগ্নিপুঁজির প্রত্যক্ষ শিকার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা ক্ষেত্র বাড়ছে, যেখানে হোয়াইট কলার কর্মচারীরাও কর্পোরেটের উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির জন্য নিজেদের শ্রম বিক্রি করেন। ব্যাপক হারে গিগ অর্থনীতি বাড়ছে। বর্তমান ভারতে পুঁজি-শ্রমের মৌলিক দ্বন্দ্ব ক্রমবর্ধমান। এই দ্বন্দ্ব তীব্র হলেও শোষিত খেটেখাওয়া মানুষের কাছে পুঁজির মালিকরা 'মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ'। তাই ভারতীয় সমাজের নতুন ধরনের প্রলেতারীয়করণ এবং বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তির বিপ্লবী ঐক্য গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এ কাজ করা গেলে পরিস্থিতির গুণগত ইতিবাচক পরিবর্তন করা যাবে। এ কাজে ব্যর্থতা হিন্দুত্ব-কর্পোরেটের নয়া ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। তাই শ্রমিক শ্রেণির সচেতন রাজনৈতিক শক্তির দায়িত্ব শ্রমজীবীদের দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণা এবং লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করা। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতীয় বাস্তবতায় শ্রমিক শ্রেণির এটাই এখন সময়ের কাজ।

Comments :0

Login to leave a comment