শ্যামল কুমার মিত্র
ভারতীয় বায়ুসেনা পূর্বতন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের কাছে ১২৬টি রাফায়েল যুদ্ধ বিমান কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ফ্রান্সের 'দাসাউ' কোম্পানির সঙ্গে ১২৬টি রাফায়েল বিমান কেনার চুক্তি করে তৎকালীন ইউপিএ সরকার ৷ ২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদীজির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার তৈরি হলো। মোদীজি ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল ঘোষণা করলেন, ''তার সরকার ফ্রান্সের 'দাসাউ' কোম্পানির সাথে ৩৬টি রাফায়েল বিমান কেনার চুক্তি করছে"। বিরোধীরা প্রশ্ন তুললেন, পুরানো চুক্তি থাকা সত্ত্বেও নুতন আরও একটা চুক্তি কেন? আগের চুক্তি বাতিল করা হলো কি কারণে? বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব বললেন, আগের সরকারের আমলে কোনও চুক্তিই হয়নি, আলাপ-আলোচনা চলেছিল মাত্র। স্পষ্টতই আগের চুক্তি বাতিলের 'দায়' ঝেড়ে ফেলতে গোয়েবেলসীয় কায়দায় ১০০ শতাংশ মিথ্যা বলেছিলেন বিজেপি’র শীর্ষ নেতারা৷ তারা জানতেন, আগের সরকারের রাফায়েল চুক্তি নতুন চুক্তির থেকে অনেক বেশি দেশ ও সেনাস্বার্থবাহী, দুর্নীতির গন্ধমুক্ত। ফলে সেই চুক্তি বাতিল ঘোষনা করলে জনমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। সুপ্রিম কোর্টে এ সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে মোদী সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল কেকে বেনুগোপাল হলফনামা দিয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, ''আগের সরকারের চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া ২০১৫ সালের মার্চ মাসে শুরু হয়ে জুন মাসে শেষ হয়। আগের সরকার যদি চুক্তিই নাই করে থাকেন, তাহলে 'আগের চুক্তি প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া' কিভাবে করলেন মোদী সরকার? সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি কেএম জোসেফের প্রশ্ন ছিল অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে, "আগের চুক্তি বহাল থাকলেও সরকার কি করে নতুন চুক্তি করলেন?'' কেকে বেণুগোপাল কোনও উত্তর দিতে পারেননি। আগের চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই (২০১৫-এর জুন) মোদীজি নতুন চুক্তির কথা ঘোষণা (২০১৫-এর ১৩ এপ্রিল) করলেন যা অত্যন্ত অশোভন। কিসের এত তাড়া? বস্তুত দেশ ও সেনার স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে প্রাণের বন্ধু অনিল আম্বানিকে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বরাত ও ফ্রান্সের 'দাসাউ' কোম্পানিকে অতিরিক্ত ৩৭,৬০৯.২ কোটি টাকা (অনিল আম্বানিদের হিসাবে ৪১,০৬০.৫২ কোটি টাকা) পাইয়ে দিতেই মোদীজি তড়িঘড়ি আগের চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তি করেন। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এত বড় দুর্নীতির দ্বিতীয় কোনও নজির নেই। এমন একটি কেলেঙ্কারি কিভাবে সুপ্রিম কোর্টে ক্লিনচিট পেল সেটাই প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রেও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির মামলায় যেভাবে সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ‘ঈশ্বরের নির্দেশ পেয়ে রায়’ দিয়েছিলেন, তেমন কোনও ঐশ্বরিক নির্দেশ ছিল কিনা জানা নেই! মোদীজির সৎসাহস থাকলে ২টি চুক্তিই প্রকাশ্যে আনুন, তাহলে মানুষ বিচার করে নিতে পারবে মোদী সরকার স্বচ্ছ না দুর্নীতিগ্রস্ত। ২টি চুক্তিতে তো রাফায়েল বিমানের উৎপাদন প্রযুক্তির বর্ণনা নেই যে তা নিরাপত্তার কারণে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তাহলে ক্রয়-বিক্রয়ের সাধারণ চুক্তি প্রকাশে বাধা কিসের? আগের এবং বর্তমান চুক্তির যে যে বিষয়গুলি ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে, সেগুলি দেখে নেওয়া যাক। পূর্বতন চুক্তিতে যা ছিল — (১) মোট ১২৬টি তৈরি হওয়া সম্পূর্ণ বিমান ভারতে পাঠাবে 'দাসাউ'। বাকি ১০৮টি বিমান ভারতে তৈরি করবে রাষ্ট্রায়ও সংস্থা 'হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ (হ্যাল) 'দাসাউ'-এর সহযোগিতায়। এজন্য 'দাসাউ' কোম্পানি ‘হ্যালকে’ রাফায়েল উৎপাদন, পরিচালন এবং মেরামত প্রযুক্তি সহ পূর্ণ প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে এবং হ্যাল-এ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে 'দাসাউ'৷ (২) প্রতিটি বিমানের দাম পড়বে ৫২৬.১০ কোটি টাকা। (৩) এদেশে দাসাউ 'এর অফসেট পার্টনার থাকবে 'হ্যাল'। (৪) চুক্তিতে ভারতকে 'সভারেন গ্যারান্টি' দেওয়ার সংস্থান ছিল, যা আন্তর্জাতিক স্তরে আইনগতভাবে বলবৎ যোগ্য। এই গ্যারান্টির ফলে চুক্তির প্রতিটি শর্ত মানতে বাধ্য ছিল 'দাসাউ'। বিমান সরবরাহ, প্রযুক্তি হস্তান্তরে বিলম্ব সহ যে কোনও মতবিরোধের মীমাংসা হতো ভারতের আদালতে। 'হ্যাল'কে কেন এদেশে 'দাসাউ' -এর অফসেট পার্টনার নির্বাচন করেছিলেন মনমোহন সরকার? ২০১৪ সালে যুদ্ধবিমান উৎপাদন ও মেরামতি এবং আধুনিকীকরণে ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা 'হ্যাল'। এসইউ-৩০, এমকেআই, এলসিএ তেজস, ডরনিয়ার ডু ২২৮, এএলএইচ ধ্রুবর মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার উৎপাদন সহ ৪০ ধরনের বিমান ও হেলিকপ্টার তৈরি করেছে 'হ্যাল'। বিমানের ১৪০টি নতুন ইঞ্জিন তৈরি, ২২০টি বিমান ও হেলিকপ্টার এবং ৫৫০টি বিমানের ইঞ্জিনের খোলনলচে বদলানোর (ওভার হল), ১৪৬টি নূতন এরোস্ট্রাকচার তৈরির অভিজ্ঞতা রয়েছে 'হ্যাল'এর। ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে 'হ্যাল'এর বার্ষিক টার্নওভার যথাক্রমে ১৭,৬০,৩৭৯ লক্ষ এবং ১৮,২৮,৩৮৬ লক্ষ টাকা। ২০১৭-১৮ তে কর পূর্ববর্তী ও কর দেওয়ার পর লাভ যথাক্রমে ৩,৩২,২৮৪ লক্ষ এবং ২,০৭,০৪১ লক্ষ টাকা। ২০১৭-১৮ তে এই সংস্থা সরকারকে দিয়েছে (কর বাবদ) ১,২৫,২৪৩ লক্ষ টাকা। অফসেট পার্টনার হিসাবে ‘হ্যাল’এর নির্বাচন সর্বোত্তম, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ২০১৫-এর ১৩ এপ্রিল নতুন চুক্তি অনুসারে মাত্র ৩৬টি রাফায়েল কেনার কথা ঘোষণা করলেন মোদীজি। তার ১১ দিন পরে ২৪ এপ্রিল জন্ম নিল অনিল আম্বানির সংস্থা 'রিলায়েন্স এরোস্ট্রাকচার লিমিটেড'। ২০১৫ সালের ১৬ জুন বিমান বন্দরের কাছে জমির আবেদন করে এই নবগঠিত সংস্থা। ২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট ২৮৯ একর জমি বরাদ্দ করে মোদী সরকার। সংস্থা ১০৪ একর জমি নেয়, কিন্তু দাম মেটায় ২০১৭ সালে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৬টি রাফায়েল কেনার ৭৮৭ কোটি ইউরোর আনুষ্ঠানিক চুক্তি করলেন মোদীজি। এই চুক্তিতে 'দাসাউ' -এর ভারতীয় সহযোগী বা অফসেট পার্টনার হিসাবে 'হ্যাল'এর বদলে অনিল আম্বানিদের এই নবগঠিত 'রিলায়েন্স এরোস্ট্রাকচার লিমিটেড'কে নির্বাচন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অনিল আম্বানিরা কখনো খেলনা বিমানও তৈরি করেনি। অনিল আম্বানিকে স্রেফ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বরাত পাইয়ে দিতে দেশের প্রতিরক্ষার সঙ্গে এত বড় 'জুয়া' খেললেন মোদী সরকার। নতুন চুক্তিতে ১টি বিমানের দাম স্থির হল ১৫৭০.৮ কোটি টাকা। 'দাসাউ' কোম্পানিকে ৩৬টি বিমান বাবদ (১৫৭০.৮ — ৫২৬.১) গুন ৩৬ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩৭,৬০৯.২ কোটি টাকা অতিরিক্ত পাইয়ে দেওয়া হলো (অনিল আম্বানিদের হিসাবে ৪১,০৬০.৫২ কোটি টাকা)। ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গ্রুপ ১টি বিবৃতিতে জানায় ৩৬টি রাফায়েল বিমানের মোট দাম পড়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ১টি বিমানের দাম ১৬৬৬.৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ 'দাসাউ' বেশি পেল (১৬৬৬.৬৭ — ৫২৬.১) গুন ৩৬ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪১,০৬০.৫২ কোটি টাকা। 'দাসাউ 'কে এত কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া হলো কোন অলিখিত, অপ্রকাশিত বিনিময় মূল্যে? সেই বিনিময় মূল্য কে বা কারা পেল? এটাই সব থেকে বড় প্রশ্ন। ঠিক কোন দামে বিমান কিনলেন মোদীজি? মজার কথা, এই চুক্তির সময়ে (২০১৬) কাতার একই 'দাসাউ' কোম্পানি থেকে একই মডেলের বিমান (রাফায়েল) ৬৯৪ কোটি টাকা দামে ১২টি কিনেছে। বায়ুসেনার দরকার ছিল ১২৬টি রাফায়েল, মোদিজী কিনলেন মাত্র ৩৬টি। ৯০টি রাফায়েল বিমান কম পেয়ে বায়ুসেনা দুর্বল হলো। এর 'দায়' মোদীজিকেই নিতে হবে। ১২৬টির বদলে ৩৬টিতেই কাজ চলে যাবে, এই পরামর্শ কোন বিশেষজ্ঞ দিলেন মোদীজিকে? নতুন চুক্তিতে কোনও প্রযুক্তি হস্তান্তরের সংস্থান নেই, তাই ভারতে এই বিমান তৈরিই হবে না। তাহলে অনিল আম্বানিরা ঠিক কি করবেন? ঐ ১০৪ একর জমিতে ঘাস চাষ করবেন? আগের চুক্তিতে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ফলে 'হ্যাল' প্রযোজনে ১২৬টির বেশি বিমানও ভারতে তৈরি করতে পারত। সব থেকে বড় কথা, নয়া চুক্তিতে 'সভারেন গ্যারান্টি'র বদলে আছে 'লেটার অব কমফোর্ট' যার কোন মান্যতা বা আইনগ্রাহ্যতা নেই আন্তর্জাতিক স্তরে। নয়া চুক্তিতে ভারত ও 'দাসাউ' -এর মধ্যে কোনও মতবিরোধ হলে সালিশি হবে জেনিভার আদালতে। ভারতের বদলে জেনিভায় মামলা হলে সুবিধা 'দাসাউ' -এর। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। মানতেই হবে, মনমোহন সিং এর বন্ধুপ্রেম না থাকলেও, মোদীজির বন্ধুপ্রেম অসাধারণ, অনবদ্য। অনিল আম্বানি যে মোদীজির প্রাণের বন্ধু। কিন্তু বন্ধুপ্রেমে যখন দেশ, সেনা, জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি ঘটে, তখনই প্রশ্ন ওঠে। ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতির গর্বে গর্বিত মোদীজি কি এই সৎসাহস প্রদর্শন করবেন, "হে দেশবাসী,এই ২টি চুক্তি প্রকাশ করলাম,আপনারাই বিচার করুন।" রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়ে পূর্বতন চুক্তি ও নুতন চুক্তি প্রকাশ করে মোদীজি প্রমাণ করুন, তিনি কোনও দুর্নীতি করেননি ২০১৬-এর নতুন চুক্তিতে।
Comments :0